রফিক মজিদ, শিলং থেকে ফিরে : আঁকাবাঁকা ও উচুনিচু পাহাড়ি পথ। রাস্তার দু’ধারে খাসিয়া পাহাড় জুড়ে মেঘ রাজ্যের মেঘদের ছুটাছুটি-লুটোপুটি খেলা। শিলংয়ের এ পথেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় অমিত আর লাবণ্যের গাড়ি। তারপর তাদের পরিচয়। অমিত-লাবণ্য মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র অমিত-লাবণ্য। মূলত ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ের প্রেক্ষাপটেই লেখা উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। এ ছাড়া শিলংয়ের নানা বর্ণনাও পাওয়া যায় শেষের কবিতায়। বলা যায়, শেষের কবিতার শুরুটা এ শিলংয়েই।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭ সালে তিন দফায় ভারতের মেঘালয়ের শিলং গিয়েছিলেন। প্রথমবার তিনি ছিলেন উম শিরপির ঝরনার পাশে কে সি দে’র ব্রুকসাইড বাংলোয়। দ্বিতীয়বার তিনি ওঠেন জিৎ ভূমিতে এবং শেষবার তিনি ছিলেন লাইতুমখারার আপল্যান্ডস-এ সলোমন ভিলা বা সিধলি প্যালেসে। পাইন আর দেবদারু বাগানঘেরা এ জিৎভূমি বাড়িতে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা ছাড়াও ‘একটি ছাউনি, একটি দিন’ লেখেন। এছাড়া তিনি কিছু অনুবাদও করেন এখানে থেকে।
শিলংয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনেক স্মৃতি। সেসব স্মৃতির খোঁজেই মেঘালয় ভ্রমনের প্রথম দিনই দিন হাজির হই শিলংয়ের রিলবংয়ের জিৎভূমি বাড়ির সামনে। এর আগেও আরেকবার যাওয়া হয়েছিল শিলং এ। কিন্তু তখন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির খবরটি জানা ছিল না আমার। এছাড়া আগের বারের ভ্রমনটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। তবে এবার পরিবার নিয়ে ভ্রমনে বের হওয়ায় আগে থেকেই শিলং দর্শনের বিভিন্ন তথ্য জেনে বের হই।
আমরা ১৬ আগষ্ট শুক্রবার সকালে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও-ঢালু ইগ্রিশন হয়ে তুরা থেকে প্রথমে গৌয়াহাটি সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি দিয়ে শিলং এর পুলিশ বাজার পৌছায় ১৭ আগষ্ট শনিবার দুপুরে। সেখানে ‘পাইন বরো’ হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভ্রমনের প্রথম দিনের সফর হিসেবে শহরের ৪/৫ টি সাইট ভিউ দেখার উদ্যেশে একটি ট্যাক্সি কার ভাড়া করে প্রথমেই চলে যাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিতে। সাথে ছিলেন আমার স্ত্রী, ৬ বছর বয়সের শিশু পুত্র আর আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। শিলংয়ের পুলিশ বাজারের অনেকটা কাছেই এ বাড়ি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, রবীন্দ্রনাথের ওই বাড়িটি এখন ‘রবীন্দ্রনাথ আর্ট গ্যালারী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় গ্যালারীটি শনি ও রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। ফলে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ও ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র, কবিতাসহ অন্যান্য তথ্য দেখা ও জানা হলো না।
তবে বাড়ির বাইরের তার স্মৃতি বিজড়িত রবীন্দ্রনাথ যেখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবতেন নেই ছায়া ঘেরা দেবদারু গাছ, বাড়ির আঙিনায় তার পায়চারির স্থানগুলোতে কিছুক্ষণ নিরবে ঘোরাফেরা করি আর ভাবি কোনো একদিন এ বাড়িতে করিগুরু থেকেছেন, বাড়ির এই আঙিনায় হেঁটেছেন, কিংবা বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসেছেন ইত্যাদি। কিন্তু আফসোস; কবির সেই পদচিহ্ন রাখা ও ব্যবহৃত আসবাবপত্র আমরা দেখতে পেলাম না।
রবীন্দ্রনাথ শিলংয়ে প্রথমবার এসে এখানেই থাকেন তিন সপ্তাহের মতো। আর্ট গ্যালারির সামনেই আছে কবিগুরুর পূর্ণাবয়ব মূর্তি। ২০১১ সালে এ মূর্তি স্থাপিত হয়। শিলং এ মূলত খাসিয়া ও গারোদের আবাসস্থল বিধায় সেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতা এসব বিষয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে জানাগেছে, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথকে চিনেই না অনেকে। যারা নাম শুনেছে তারা অবাঙালী হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। ফলে সেই আর্ট গ্যালারীতে স্থানীয়দের পদচারনা নেই বল্লেই চলে। যারা আসেন তাদের বেশীর ভাগই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী আর বাংলাদেশের পর্যটকরাই ভীর করে সেখানে।
শিলংয়ে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি বাড়ি লাইতুমখারার আপল্যান্ডস-এ সলোমন ভিলা বা সিধলি প্যালেস। বেশ কয়েক বছর আগেই এ প্যালেস ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেজন্য আমরা আর সেদিক গেলাম না। এরপর চলে যাই আমাদের পরবর্তি ভ্রমন তালিকায়।
প্রয়োজনীয় তথ্য : শিলং যাওয়ার জন্য মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডার সহজ মাধ্যম। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি বর্ডার। ডাউকি থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যায় শিলংয়ের।
তবে আমাদের ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাসহ দেশের রাজশাহী ও দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের জন্য শেরপুরের এই নাকুগাঁও ইমিগ্রেশন হয়ে সহজ রাস্তা রয়েছে। শেরপুর হয়ে তুরা এবং ভরতের আসাম রাজ্যের গৌয়াহাটি হয়ে লম্বা ভ্রমন আপনাকে বাড়তি আনন্দ দিবে তুরার বিশাল বিশাল আঁকাবাঁকা পাহাড় আর গভীর জঙ্গলের শিহরিত পথ। এ পথে শিলং ভ্রমনে ইচ্ছে করলে এক দিনের যাত্রা বিরতি দিয়ে এক ঝলক আসাম রাজ্যের রাজধানী গোয়াহাটিও দেখে যেতে পারেন। এখানে শিলং এর চাইতে হোটেল ভাড়া অনেক কম। ৫শ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে হোটেল পেয়ে যাবেন। তবে এখানে বাংলাদেশের মতোই বেশীর ভাগ সময় প্রচন্ড গরম আবহাওয়া বিরাজ করে। কেবল মাত্র শীতকালে কিছু ঠান্ডা থাকে।
যদিও বর্তমানে ঢালু বর্ডার থেকে সরারসি শিলং এর কোন বাস সার্ভিস চালু হয়নি এবং ঢালু থেকে তুরা শহরের ৪৫ কিলোমমিটার সড়কের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। তাই ঢালু থেকে ৭০ থেকে ১০০ টাকায় ভাড়ায় বাস ও উইঞ্জার (মাইক্রোবাস জাতীয়) করে এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে তুরা পৌছে সেখান থেকে ভোরে উইঞ্জার এবং নাইট বাসে শিলং যেতে পারেন। এছাড়া ঢালু বর্ডার থেকে বর্তমানে গৌয়াহাটি যাওয়ার জন্য প্রতিদিন বিকেল ৫ টায় একটি বাস চালু রয়েছে। ইচ্ছে করলে ওই বাসে গৌয়াহাটি গিয়ে সেখান থেকে মাত্র ২ ঘন্টায় পৌছতে পারবেন ভাড়া করা ট্যাক্সি, পাবলিক বাস সার্ভিস অথবা উইঞ্জার জাতীয় বিভিন্ন পরিবহনে। ভাড়া ট্যাক্সি ৪ সিটের জন্য ১ হাজার ৫ শত টাকা আর বাস ভাড়া মাত্র ১০০ টাকা।
সরাসরি পুলিশ বাজার গিয়ে বুক করতে পারেন যে কোন হোটেল। তবে আগে থেকে অললাইনে হোটেল বুকিং থাকলে ঘুরে ঘুরে হোটেল খোজার ঝামেলাটা আর থাকে না। শিলং বেড়ানোর মূল আকর্ষনীয় স্থান হলো চেরাপুঞ্জি। তবে ডাউকি ফুট ব্র্রীজ, মাউলিং ভিলেজ, টাইটানিক ভিউ, সেভেন সিস্টার ফলস, প্রকৃতিক গুহা, ওয়াটার ফলসসহ শহরের ভিতর রয়েছে এলিফ্যান্ট ফলস, শিলং পিক, লেকসহ আরো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।
থাকার জন্য শিলং পুলিশ বাজার ও লাইতুমখারায় অনেক হোটেল আছে। ভাড়া ডবল রুম ২০০০ থেকে ৭০০০ রুপি পর্যন্ত। এ ছাড়াও কমবেশি মানের হোটেল আছে। সিঙ্গেল বা ডবল রুমে চাইলে আলাদা ম্যাট নিয়ে বাড়তি লোকও থাকতে পারবেন। ম্যাটের জন্য আলাদা কিছু রুপি দিতে হবে। এক রুমে একজনই অতিরিক্ত থাকতে পারবেন। হোটেলে থাকার জন্য পাসপোর্টের ফটোকপি ও ছবির প্রয়োজন হবে। ডলার ভাঙানোর জন্য পুলিশ বাজারে অনেক মানি এক্সচেঞ্জ আছে।
খাওয়ার জন্য পুলিশ বাজার ও লাইতুমখারায় অনেক বাঙালি খাবারের হোটেল আছে। ১০০ রুপি থেকে ৩০০ রুপিতে ভাত-মাছ-মাংস-রুটি সবই পাবেন। একই দামে খাবার পাবেন দর্শনীয় স্থানগুলোর পাশে থাকা হোটেলগুলোতেও। এছাড়া অর্ডার দিলে হোটেল থেকেও খাবারের ব্যবস্থা করে দিবে। তবে সেক্ষেত্রে মূল্য একটু বেশী পড়বে।
শিলং শহর পুলিশ বাজারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। তাই সব কেনাকাটা করা যাবে এ বাজারেই। এক দামের দোকান ছাড়া দামাদামি করে কেনার সুযোগও আছে। শিলংয়ের একমাত্র বাহন ট্যাক্সি। তাই কাছাকাছি কোথাও গেলেও ট্যাক্সিতে যেতে হবে। চারজন মিলে কাছাকাছি ভাড়া ৫০ থেকে ১০০ রুপি।
লেখক : সাংবাদিক ও কবি, শেরপুর, মেবাইল : ০১৯১৮-৮৯৩৬২১।