‘চিঙনী খুসুক সালনা সালনা জিমাংজক’ (আমাদের ভাষা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে) আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সমাজের (বাগাছাস) নেতা কাঞ্চন মি. মারাক।
সীমান্তবর্তী শেরপুরে সাতটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ৫৪ হাজার মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে গারো, কোচ, বর্মণ, হাজং ও হদিরা সম্প্রদায়ের জাতিগোষ্ঠীর মানুষই বেশি।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। এসব জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু দিন দিন নানান কারণে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠির নেতারা।
ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে দ্রুত কালচারাল একাডেমি স্থাপন করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসন।
বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্যমতে, জেলায় গারো ১৬ হাজার ৫০০, হাজং ৪ হাজার ৭০০, হদি ১০ হাজার ৬০০, বর্মণ ১৭ হাজার, কোচ ৩ হাজার ৬০০, ডালু ১ হাজার ১০০, বানাই ১১০ জন রয়েছেন। এরা বেশিরভাগ সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ি উপজেলায় বাস করেন।
গারো, কোচ, বর্মণ, হাজং, ডালু, বানাই ও হদিদের ছিল নিজস্ব ভাষা ও আচার, অনুষ্ঠান। কিন্তু কালের বিবর্তনে গারো, কোচ ও হাজংদের ভাষা টিকে থাকলেও ডালু, বানাই, বর্মণ ও হদিদের মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে। এসব সম্প্রদায় তাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারে না। তারা এখন বাংলা ভাষাতেই কথা বলে।
বানাইপাড়ার প্রবাধিনী কোচ বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলতে চাই। কিন্তু বাংলা ভাষায় কথা বলতে বলতে আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাগো ভাষা ভুলেই যাচ্ছে। স্কুলে আমাগো ভাষার বই দিছে। কিন্তু সেটা তো পড়ায় না। বাংলাই পড়ায়।’
গজনী এলাকার চাকনী কোচ বলেন, ‘স্কুল-কলেজে আর আমাগো ভাষা শিখায় না। তাই আমাগো পোলাপানরা আমাগো ভাষায় কথা বলতে চায় না। বাংলা ভাষায় কথা কয়।’
স্কুলছাত্র স্বপ্ন হাজং বলেন, ‘আমাগো স্কুলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা পড়ায়। আমাগো ভাষার বই দিছে, কিন্তু স্যার নাই।’
নালিতাবাড়ির কাকরকান্দি ইউপির সাবেক মহিলা সদস্য সুরেশা দেবী বলেন, ‘ছোট বেলায় বাপ দাদার মুখে ডালু ভাষায় কথা শুনতাম। চন্দ্রের সময়ের সাথে মিল রেখে আয়োজন হতো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সারারাত ডালু ভাষায় গান হতো, আড্ডা হতো। এখন আর ডালু ভাষায় কথা বলার কেউ নেই। সবাই ভুলে গেছে ভাষাটি।’
বর্মণ সম্প্রদায়ের নেতা হিরুণ চন্দ্র বর্মণ ও অনিন্দ্র চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘আমাদের ভাষা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। আমাদের বর্মণ ভাষা সংগ্রহের জন্য আমরা দুজনে বিভিন্ন জেলায় গিয়েছি। কিন্তু সবজায়গায় একই অবস্থা, চর্চার অভাবে ভাষাটির বিলুপ্তি হয়েছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে হয়তো আমাদেও মাতৃভাষাটি ফিরে পাওয়া যেত।’
বাংলাদেশ গারো ছাত্র সমাজের শ্রীবরদী শাখার নেতা দালবত মলয় বলেন, ‘আমাদের গারো ভাষার লিখিত কোন রূপ না থাকায় বিভিন্ন সময় ল্যাটিন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা হয়। যা সবাই পড়তে পারে না। তাছাড়া বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষার শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভাষা শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব পোশাক, সাংস্কৃতিও হারাতে বসেছে।’
বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী ইউনিয়নের সভাপতি রয়েল কোচ বলেন, ‘আমাদের ভাষা বড়রা পারলেও নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছে। কারণ বিদ্যালয়ে বায়লা ভাষাতেই কথা বলে, বাইরে গেলেও বাংলায় ব্যবহার করে। আর বাড়িতে এখন আর আগের মতো কোচ ভাষার চর্চাও নেই। তাই সরকারের কাছে দাবি আমাদের কোচ ভাষাটা সংরক্ষণ করে রাখার।’
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নালিতাবাড়ি সভাপতি কোপিন্দ্র নখরেক বলেন, ‘দেশের সকল নাগরিকই যাতে মাতৃভাষা শেখার ও চর্চা করার সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের গারো পাহাড়ে বসবাসরত বর্মণ, হদি, ডালু ও বানাই সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা হারিয়ে গেছে। এসব ভাষা উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।’
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের শেরপুরের সভাপতি ডেনিশ দুলাল মারাক বলেন, ‘২০১৭ সালে প্রাক প্রাথমিকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই দেওয়া হয়। সেসময় পাঁচটি ভাষায় বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসেনি। তাই সরকারের কাছে আমাদের পাহাড়ি এলাকাগুলোর স্কুলে মাতৃভাষার শিক্ষক পাশাপাশি একটি কালচারাল একাডেমির দাবি জানাচ্ছি।’
বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের ফেলো সুমন্ত বর্মণ বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে এই নৃগোষ্ঠীদের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর এখানে বসবাসরত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ছাড়া শিক্ষা বা কোনো কাজেই তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। প্রবীণরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম তাদের ভাষা হারাতে বসেছে। আমাদের গারো পাহাড়ে ইতিমধ্যে ডালু, বানাই, বর্মণ ও হদিদের মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে। হারানো ভাষাগুলো সংগ্রহের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপকের সাথে কথাবার্তা বলেছি।’
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল মি. সাংমা বলেন, ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর একটি জাতি বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকে থাকে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। পরিচর্চার অভাবে আজ তারা ভাষা ও সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে মাতৃভাষায় বই ও শিক্ষক এবং গারো পাহাড়ে একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপন করতে হবে।’
জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, শেরপুর জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা রয়েছেন তাদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হয়েছে। তবে মাতৃভাষা পড়ানোর জন্য শিক্ষকের কিছুটা সঙ্কট রয়েছে। এ সমস্যা দূর করার জন্য দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপন করা হবে।