চরাঞ্চলের অগোচানো সড়ক, সড়কে সারি সারি মালবাহী টমটম গাড়ি, গাড়িতে বস্তাভর্তি আলুবোঝাই দিচ্ছে ব্যাপারিরা, মাঠে কৃষক কৃষাণির স্বপরিবারে আলু তোলার দৃশ্য, সবার মুখে আনন্দের হাসি আলুর ফলন ভালো হওয়ায়। কম খরচে অধিক মুনাফা পাওয়ায় দিন দিন আলু চাষে ঝুঁকছেন শেরপুরের কৃষক। মৌসুমের শুরুতে শৈত্যপ্রবাহ ও বৈরী আবহাওয়া থাকলেও এবার আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জেলা সদর, নকলা, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৫ হাজার ২২২ হেক্টর জমিতে ৮৮ হাজার ৭৭৪ মেট্রিক টন আলুর ফলন হয়েছে।
কৃষি বিভাগ চলতি বছরে ৫ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও এবার তার চেয়েও বেশি জমিতে পণ্যটির আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদিত এসব আলুর বাজারমূল্য ১৮৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা হবে বলে জানায় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) শেরপুর জেলা কার্যালয় জানায়, উৎপাদিত এসব নতুন ও বড় জাতের আলুর চাহিদা বেশি বিদেশে। কারণ এসব আলু দিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। তাই এ বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ২০০ টন শেরপুরের আলু রপ্তানি হবে মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়। জেলায় এ বছর অন্যান্য জাতের পাশাপাশি ডায়মন্ড, এডিসন, বারি ৪০, বারি ৪১, সানসাইন, সান্ত্বনা, রশিদা, ক্যারোলা জাতের নতুর জাতের আলুর চাষ বেশি হয়েছে।
সদর উপজেলার কামারের চরের কৃষক শামছুল হক বলেন, ‘আমি এবার এক কুর (একর) জমিতে আলু চাষ করেছি। ৭০ দিনের মধ্যে আলু উঠছে (পরিপক্ব) হয়েছে। পাইকাররা আমার এক একর জমির আলু ক্ষেত আগেই কিনে নিছে। খরচ বাদে এবার আমার ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি লাভ হয়েছে। সামনেরবার আলুর আবাদ আরও বেশি করে করুম।’
শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচরের আলু চাষি হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে মৌসুমের শুরুর দিকে যে আবহাওয়া ছিল তাতে আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কারণ বেশি কুয়াশা থাকলে আলুর গাছ পচে যায়। পরে আবহাওয়া ভালো হয়েছে, আলুরও ফলন ভালো হয়েছে। দুই একরের কিছু বেশি জমিতে আমার লাখখানেক টাকা টিকছে। আর আমি আলু তুলেই পাট বুইন্না (বপন) করে দিছি।’
নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনার আলু চাষি আব্বাস আলি কালু বলেন, ‘আমি দেড় একর জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। ফলনও ভালো হয়েছে। আমার মোটামুটি ৫০ হাজার টাকার মতো টিকছে। আলু তুলে আমি পাট ও ভুট্টার আবাদ করেছি। এতে আমার বাড়তি আয় হবে।’
আলু চাষে কৃষকের লাভের পাশাপাশি আলুগাছ কর্তন ও বাছাইয়ে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো নারীর। একেকজন নারীশ্রমিক এ কাজে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরি পান। যেখানে মাসব্যাপী এই কাজের আয়ে সংসারের চাকা সচল রাখতে অনেকটাই সহযোগিতা করে।
নকলা উপজেলার চর বাছুর আগলা গ্রামের শিউলী বেগম, রেহানা পারভীন, মুনীরা বেগমসহ কয়েকজন নারীশ্রমিক জানান, তিনি আলুর মৌসুমে আলু তোলার কাজ করেন। দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরি পান। আর ক্ষেত তুলে দিলে তাদের আলুও দেয় গৃহস্থ। আলুর মৌসুমের পর ভুট্টা তোলার কাজ করি। এতে তাদের সংসারে বাড়তি আয়ও হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিবানী রাণী নাথ বলেন, ‘শেরপুরের মাটি সবজি আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মাটি আলু চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত, তাই চরে আলুর ফলন তুলনামূলক বেশি হয়।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমারা বিভিন্নভাবে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করেছি। চলতি বছরে ৫ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বছরের শুরুতে শৈত্যপ্রবাহ ও আবহাওয়া খারাপ থাকলেও জেলায় আলুর বাম্পার ফলনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে।
বিএডিসির শেরপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো.খলিলুর রহমান বলেন, ‘আলু চাষে লাভ বেশি থাকায় দিন দিন এই সবজি চাষে শেরপুরের কৃষক আগ্রহ পাচ্ছেন। আমরা দেখতে পেলাম এ বছর আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদিত নতুন ও বড় জাতের আলুর চাহিদা বিদেশে বেশি। কারণ এসব আলু দিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। আশা করছি এ বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ২০০ টন আলু রপ্তানি হবে মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়।