:আব্দুর রফিক মজিদ/এম. সুরুজ্জামান:
শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে এখন দুলছে সবুজ মাল্টা। পাহাড়ি উচুনিচু টিলা আর টিলা ঘেষা পতিত জমিতে অনেকেই এখন ঝুকছে মাল্টা চাষে। ফলটি খুব লাভজনক ও সুস্বাধু হওয়ায় জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে মাল্টা চাষ। দেশীয় প্রযুক্তিতে চাষকৃত এসব সবুজাভ মাল্টার চাহিদাও রয়েছে বেশ।
শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি সুনিষ্কাশিত, উর্বর, মধ্যম থেকে দোঁ-আশ এবং এখানকার আবহাওয়া শুষ্ক ও উষ্ণ হওয়ায় এখানে সাইট্রাস (লেবু) জাতীয় ফল চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। আর এ জাতীয় ফল বিশেষ করে লেবু ও মাল্টা চাষ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় ও একই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
সুত্রে জানা গেছে, গত তিন বছর আগে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় লেবু ও মাল্টা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন উদ্যোক্তা আব্দুল বাতেন। বাতেন ঝিনাইগাতী উপজেলার হলদী গ্রামের মৃত- মফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি পেশায় সরকারি গাড়ি চালক। আরো নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হলে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে এ অঞ্চলে লেবু ও মাল্টা চাষে বিপ্লব ঘটবে এবং এই বিদেশী ফলটিই দেশে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করেন আব্দুল বাতেন। একই সঙ্গে এ অঞ্চল অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উদ্যোক্তা আব্দুল বাতেন জানান, সীমান্তে হাতির উপদ্রব থাকায় তার সাড়ে ৭ একর জমি পতিত পড়ে থাকত। গত চার বছর আগে কৃষি বিভাগের লোকজনের পরার্মশে ২ একর জমিতে সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ব্লক প্রদর্শনীর মাধ্যমে ও তার নিজ উদ্যোগে আরও আড়াই একর জমিতে লেবু জাতীয় ফলের চাষ শুরু করে। বর্তমানে তার বাগানে ১৩০০ সীডলেস ও ৫০০ কাগজী লেবু, ৩০০ মাল্টা, ২০ কমলা, ২০ জাম্বুরা ও ৬০টি আম গাছ রয়েছে। বাগান দেখা-শুনা করার জন্য ৩জন শ্রমিক রয়েছে বছর চুক্তিতে। এছাড়া দৈনিক মুজুরি ভিত্তিতে ৫জন শ্রমিক কাজ করে।
এ পর্যন্ত আব্দুল বাতেনের খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। শুধু লেবু বিক্রি করেছেন সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। মাল্টার প্রথম বছর বিক্রি হয় ১ লাখ ২০ হাজার এবং গত বছর বিক্রি হয় ৩ লাখ টাকা। এ বছর টার্গেট আরো অনেক বেশী।
আব্দুল বাতেন ছাড়াও আশপাশের অনেকেই ঝুকছে মাল্টা চাষে। নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা গ্রামে গাজিপুর থেকে এক উদ্দ্যোক্তা শওকত আলম প্রায় ৩ একর পাহাড়ি টিলার উপর বেশ কয়েক বছর আগে মিশ্র ফল বাগান করেন। গত দুই বছর থেকে অন্যান্য ফল বাগানের পাশাপাশি মাল্টা চাষ শুরু করেছেন। তিনিও বেশ লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া পাহাড়ি টিলা ছাড়াও বিভিন্নস্থানে অনেকেই নিজস্ব জমিতে ৫০ থেকে ১০০ টি মাল্টার চাড়া রোপন করে মাল্টা চাষের দিকে ঝুকছেন। এছাড়া উলেখিত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় বেশ কিছু মাল্টা বাগান গড়ে উঠেছে।
পাহাড়ি বিভিন্ন টিলা ও টিলা ঘেষা বিভিন্ন পতিত জমিতে সাড়ি সাড়ি মাল্টা গাছ। সেসব গাছে লিচুর মতো থোকা থোকা গাঢ় সবুজ রঙের মাল্টা ঝুলছে প্রতিটি গাছে। বারি-২ ও বারি-৪ জাতসহ অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তনী বিভিন্ন প্রজাতির মাল্টার চাষ হচ্ছে শেরপুর এলাকায়। বিদেশী রঙ্গীন মাল্টার মতো এ মাল্টার রঙ সবুজ হলেও স্বাধ ও গন্ধে অতুলনীয় এবং এর পুষ্টি গুনও অনেক বেশি। তবে চাষিরা জানান বিদেশী মাল্টার মতো রঙ আনতে ক্যামিক্যাল ব্যবহার করলেই আধ ঘন্টার মধ্যেই এর রঙ বাজারের বিদেশী মাল্টার মতোই হয়ে উঠে। কিন্তু তারা সেটা না করে দেশিয় প্রাকৃতিক সবুজ রঙের মাল্টাই সাধারণ মানুষের মনে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে পরিপূর্ণ মাল্টার রঙ প্রাকৃতিক ভাবেই কিছুটা হালকা কাঁচা হলুদের রঙ আসে। এসব মাল্টা শেরপুর জেলাসহ ঢাকায় বেশ চাহিদাও রয়েছে। শেরপুরের খোলা বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষক আব্দুল বাতেন আরো জানান, প্রথম প্রথম এলাকায় যখন মাল্টা চাষ শুরু করেন তখন স্থানীয়রা হাসতেন এবং বলতেন ছেলেটার মাথা খাড়াপ হয়েছে বিদেশী ফল কী আর এখানে হবে। কিন্তু যখন মাল্টার ফলন হলো এবং তার খেতে বিদেশী মাল্টার চেয়ে অনেক সুস্বাধু হয় তখন ওই নিন্দুকদের চোখ ছানাবর হয়ে উঠে। দিন দিন আমাকে দেখে আশপাশের অনেকেই ঝুকে পড়ে মাল্টা চাষে।
এ বিষয়ে দেশিয় ফল নিয়ে কাজ করা অনলাইন উদ্দোক্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গারো পাহাড়ে উৎপাদিত মাল্টা ই-কমার্স মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে আমরা পরিকল্পনা করেছি। তাই গত ঝিনাইগাতি এলাকায় বেশ কয়েকটি বাগান পরিদর্শনে গিয়েছি এবং মাল্টা খেয়েছি। অন্যান্য মাল্টার চেয়ে স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে শেরপুরের মাল্টার।
ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, এ এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ু সাইট্রাস লেবু জাতীয় চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় (বর্তমানে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে, লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপন ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প) কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ বিনামূল্যে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ডা. মুহিত কুমার সাহা জানান, জেলায় সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরর্দীসহ সদর উপজেলাতে মোট ২৪ হেক্টর জমিতে মাল্টার চাষ হচ্ছে। এসব মাল্টা বিদেশী ও দেশে উৎপাদিত অন্যান্য জেলার মাল্টার চেয়ে অনেকগুন বেশি সুস্বাদু। এছাড়া আশা করা হচ্ছে জেলায় আগামিতে মাল্টার আরো আবাদ বাড়বে।