ড. এ.কে.এম. রিয়াজুল হাসান :
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন শেরপুরে তেমন জোরালো প্রভাব ফেলেনি। তবে শহরের স্কুলগুলোতে ছাত্ররা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দুই বা তিন দিন ক্লাস বর্জন করে। কমিউনিস্ট নেতা হারু পাল ছাত্রদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে বৈঠক করতেন। হেমন্ত ভট্টাচার্য ও রবি নিয়োগী তাদের বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন। ভাষা আন্দোলন শেরপুরে দানা বাঁধে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলির প্রতিবাদে। অবশ্য বাংলা ভাষার দাবিতে ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ থেকেই ছাত্রদের মিছিল, জনসমাবেশ ও ধর্মঘট চলতে থাকে। এই সব কর্মকা-ের নেতৃত্বে ছিলেন তরুণদের মধ্যে হাবিবুর রহমান, নিজামউদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, আব্দুর রশীদ, আহসান উল্লাহ, সৈয়দ আবদুস সোবহান, সৈয়দ আব্দুল হান্নান প্রমুখ। তাঁরা ছাত্রদের সমবেত করে বিভিন্ন জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদেরকে রাজনৈতিক পরামর্শ ও সহায়তা দিতেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শেরপুর থানা যুবলীগের সভাপতি খন্দকার মজিবুর রহমান, আওয়ামী মুসলিম লীগের নূর মোহাম্মদ উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান। শেরপুরের জি.কে.পি.এম. ইনিস্টিটিউট, ভিক্টোরিয়া একাডেমী, শেরপুর মাদ্রাসা ও কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। ডা.আনোয়ারুল ইসলাম ডিম, খন্দকার নুরুল হক, আহমেদ সালেহ, অরুণ বক্সী, অমিত বক্সী, চিত্ত বক্সী, সিরাজুল হক, শওকত জাহান লুদু মিয়া, আব্দুল হারুন, সাদেকুর রহমান, শফি উদ্দিন, নাসির উদ্দিন, মহসিন আলী, শামসুল হুদা, হিরা মিয়া, জাহানারা বেগম, টিপু সিং, মোহাম্মদ ইউসুফ (মাদ্রাসার ছাত্র), কলিম উদ্দিন এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলির সংবাদ সেদিন সন্ধ্যায় শেরপুরে পাওয়া যায় রায়চরণ সাহার রেডিওতে। সেটিই ছিল শেরপুরে তৎকালীন একমাত্র রেডিও। এছাড়া লোকমারফত পরদিন দুপুর বারোটায় ঢাকার সংবাদ পৌঁছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন বিকেলে শহরে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হয়। স্থানীয় স্কুলের ছাত্ররা মিছিলে অংশ নেয়। ছাত্ররা ছাড়াও সচেতন জনগণও মিছিলে যোগ দেয়। এই মিছিলে প্রায় এক হাজার লোক অংশগ্রহণ করে।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের শুকল বিল্ডিংয়ে ‘সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের শেরপুর থানা শাখার সভাপতি নূর মোহাম্মদ উকিল। পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি নয়ানি বাড়ি মাঠে এই কমিটির উদ্যোগে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৪-৫ হাজার লোক উপস্থিত ছিল। এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ সভা শেরপুর পৌরসভার পার্শ্ববর্তী এলাকার হাটবাজারেও অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালের মার্চে সারা দেশে যে হরতাল আহ্বান করা হয় সেটিও শেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী সকল থানা ও ইউনিয়নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর ১৬ মার্চের একটি সংবাদ ছিল নি¤œরূপ:
“শহীদ দিবস উপলক্ষে অদ্য (৫ মার্চ ১৯৫২) শ্রীবর্দী এবং দেওয়ানগঞ্জ থানার সর্বত্র হরতাল প্রতিপালিত হয়। কৃষকগণ হাল চালনা হইতে বিরত থাকে। ১২ টার পর হইতে বক্শীগঞ্জ, নিলক্ষিয়া, ভায়াডাঙ্গা স্কুলের ছাত্ররা মিছিল করিয়া শ্রীবর্দীর দিকে আসিতে থাকে। মিছিলের পরই বহু জনসাধারণ স্কুল প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। অপরাহ্ন ৪ টার সময় দশ সহ¯্রাধিক ছাত্র ও জনসাধারণের এক সভা হয়।”
মুসলিম লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা আফসার আলী খান বাংলা ভাষার দাবির প্রচ- বিরোধী ছিলেন। তবে শেরপুর মুসলিম লীগের সভাপতি খান বাহাদুর ফজলুর রহমান এক্ষেত্রে তেমন জোরালো বিরোধিতা করেননি। তিনি আইনগত সমাধানের পক্ষপাতী ছিলেন। শেরপুরের গৌরবময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রভাবে মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতৃবর্গের অনেকেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ। সে কারণে ১৯৪৬ ও ১৯৫০ সালে প্রবল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় শেরপুরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় শেরপুরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœ ছিল। ১৯৫২ সালে সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়ানি বাড়ির নাটমন্দিরের সম্মুখের মাঠে সৈয়দ আফরোজের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় বাংলা ভাষা সমর্থক ছাত্ররা ভাষার পক্ষে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাদের পদত্যাগ করার জন্য দাবি উত্থাপন করে। স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাদের ১৫-১৬ জন সদস্য জনসমক্ষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে এদের অনেকেই এই পদত্যাগ বহাল রাখেননি।
ভাষা আন্দোলনকালে স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা বিরোধীদলগুলোর উপর নির্যাতনের প্রকাশ্য নির্দেশ না দিলেও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ বিভাগ আন্দোলনকারীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করতো। প্রতিটি মিছিল ও সমাবেশে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তারা নেতৃস্থানীয়দের উপর কড়া নজর রাখতো। ছাত্রনেতা সৈয়দ আব্দুস সোবহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে শেরপুর থেকে গ্রেফতার হন। এ ছাড়া খন্দকার মজিবুর রহমান, নিজাম উদ্দিন আহমদ, আহসান উল্লাহ প্রমুখকে গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়। শহীদ মিনার নির্মাণ, শহীদ মিনারে পুষ্পঅর্পণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতেও গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত থাকে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শেরপুরের চকবাজার নামক স্থানে একটি খোলা মাঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় প্রগতিশীল নেতৃবর্গ। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট নেতা হাবিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৫৩ সালের ২৮ নভেম্বর শেরপুর পৌরসভা কার্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্থানীয় জি.কে.পি.এম. ইনিস্টিটিউট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্কুল, শেরপুর মাদ্রাসা ও গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে ১৩ সদস্যের একটি ‘শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি’ গঠন করা হয়। মনসুর আলী ও নিজাম উদ্দিন আহমদ শহীদ মিনারের জন্য ইট দিয়ে সাহায্য করেন। তৎকালীন আড়াই আনি জমিদারের বড় তরফের ম্যানেজার ক্ষীতিধর রায়ের নিকট রবি নিয়োগীর নেতৃত্বে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য জায়গা ব্যবহারের অনুমতির আবেদন করা হয়। তাঁর মৌখিক স্বীকৃতি নিয়ে চকবাজারে দেবোত্তর সম্পত্তির উপর শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু হয়। রাজমিস্ত্রি বিশ্বনাথ চৌহান রাতের অন্ধকারে আলো জ্বেলে গোপনে তিন ধাপের একটি বেদি নির্মাণ করে সেটির উপর একটি পিলার তুলতে সক্ষম হন। টাকার অভাবে মিনারের গায়ে পলেস্তারা লাগানো সম্ভব হয়নি। এভাবেই ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গোলার আঘাতে ধ্বংস হবার পূর্ব পর্যন্ত এই শহীদ মিনারেই শেরপুরের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- অনুষ্ঠিত হতো।
১৯৪৮-৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শেরপুরের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে পূর্বের তুলনায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে যায়। দেশ বিভাগের ক্ষত এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব কমে আসে। রাজনৈতিক দল বহির্ভূত অনেক স্থানীয় এলিট এ তৎপরতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে রাজনীতিক্ষেত্রে মুসলিম লীগের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী খোন্দকার আব্দুল হামিদের নিকট মুসলিম লীগের প্রার্থী খান বাহদুর ফজলুর রহমান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
তথ্যসূত্র
সাক্ষাৎকার: ১. ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতিবিদ রবি নিয়োগী, ২. খন্দকার মজিবুর রহমান, ৩. হাবিবুর রহমান ৪. অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান, ৫. অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ ৬. অধ্যক্ষ (অবঃ) সৈয়দ আব্দুল হান্নান, ৭. আবুল কাশেম, ৮. আব্দুর রশীদ, ৯. মহসীন আলী, ১০. রনজিৎ নিয়োগী।
ড. এ.কে.এম. রিয়াজুল হাসান
অধ্যক্ষ, শেরপুর সরকারী কলেজ