একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক কিংবদন্তি আলহাজ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক ‘বার’ এর লোমহর্ষক বীরত্বগাথা শুনলে এখনো শরীরে শিহরন জাগে। কাঁপুনি দেয় যে কোনো মানুষের শরীরে। সত্যিই তিনি একজন অকুতোভয় সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শণের স্বীকৃতিস্বরুপ কোন যোদ্ধাকে সরকার একই বীরত্ব দুইবার প্রদান করে সম্মানীত করলে লেখার শেষে নামের শেষে বীরত্ব উপাধি লেখার পর প্রথম বন্ধনীতে ‘বার’ লেখা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীকের খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তাদের মধ্যে জহুরুল হক মুন্সীই একমাত্র দুইবার বীর প্রতীকের খেতাব অর্জণ করেছেন। এজন্য তাকে বীর প্রতীক ‘বার’ বলা হয়। বাংলাদেশ সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন ৮/২৫/ডি-১/৭২-১৩৭৮ তারিখ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩-এ ক্রমিক নম্বর ৩৯১ এবং ৪০০-এ জহুরুল হক মুন্সীর নাম প্রকাশিত আছে। খেতাবধারী কিংবদন্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী অনাদিকাল এ বাংলার জনপদে অহংকার হয়ে থাকবেন।
জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রাবাজ গ্রামের কৃষক গফুর মিয়ার ছেলে জহুরুল হক মুন্সী। বর্তমানে তিনি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী পৌর শহরের খামারীয়া পাড়া মহল্লার বাসিন্দা। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখো মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তিনি অন্যতম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে অর্জণ করেছেন বীর প্রতীক ‘বার’ খেতাব। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহনের সময় ২৬ বছরের সেই টসবগে যুবক আজ বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুয়ে পরেছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে একাত্তুরের রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করে শেরপুর টাইমস ডটকমকে জানান, যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে নারায়নগঞ্জের জাহাজ নির্মান সংস্থায় (ই.পি.আই.ডি.সি) মাসিক ৪৫ টাকা বেতনে চাকরি করতাম। জাহাজ নির্মাণ সংস্থা থেকে বেতন ছাড়া তিন মাসের ছুটি নিয়ে শফিপুর আনসার একাডেমি থেকে আনসার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় প্রতিদিন বিকালে এক মাসের জন্য সিভিল ডিফেন্স প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তিনি বাড়তি শ্রম ব্যয়ে নিজেকে তৈরি করেছিলেন দেশের ভবিষ্যতের এক সৈনিক হিসাবে। একাত্তুরের ১০ ডিসেম্বর পাক হানাদাররা আনুষ্ঠানিক ভাবে আতœসমর্পণ করলে জামালপুর মুক্ত হয়। উত্তোলিত হয় সবুজের বুকে লাল পতাকা। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায় হাজার হাজার জনতা। চারদিকে ছড়িয়ে পরে জহুরুল হক মুন্সীর বীরত্বের কথা। তিনি তার দু:সাহসী এডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আবারও তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠেন। ফিরে যান সেই অগ্নিঝরা অতীতে। একের পর এক বলে যান সেই অগ্নিঝরা অতীতের গৌরবময় অধ্যায়ের বীরত্বের কথা।
তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুনার পর স্বাধীকার আন্দোলনের জন্ম নেয় মনে। ২৫ মার্চের রাতে পাকহানাদারদের নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের হত্যাযজ্ঞ ও নির্মম বর্বরতায় নিজেকে আর ধরতে রাখতে পারি নাই। মনে মনে সংকল্প করেছিলাম আর বসে থাকলে চলবে না। রুখে দাঁড়াতে হবে পাক হায়েনাদের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করতে হবে দেশের মাটি ও মানুষদের। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাদের হত্যাকান্ডের খবর নারায়নগঞ্জে পৌঁছতেই স্বেচ্ছাসৈনিকরা পুলিশ এবং স্থানীয় ট্রেজারিতে রক্ষিত আনসারদের ৩০৩ রাইফেল ও গুলি হস্তগত করে। এদের ছিলনা কোন সামরিক প্রশিক্ষণ। নিজেদের মত করে নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে জহুরুল হক মুন্সি একজন। পরে তিনি অনেক চড়াই ওতরাই পেরিয়ে ছুটে এলাম নিজ জন্ম ভূমিতে। পরে ১৯৭১ এর ১২ এপ্রিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নাম লেখাই নাছির কোম্পানীতে। বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে শুরু হয় মৌলিক প্রশিক্ষণসহ বিশেষ প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে আমাকে সাংগঠনিক কমান্ডারের দায়ীত্ব দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ইনটেলিজেন্স কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত হই। ৭১-এর রণাঙ্গনে নারায়নগঞ্জ, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও বকশিগঞ্জে পাক সেনাদের সাথে সন্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি। এসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকবাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য কখনো বাদাম, পান,বিড়ি, সিগারেট, কলা বিক্রেতা ও বুট পালিশওয়ালা সেজে পাক সেনাদের ক্যাম্পে ঢুকে পরতাম। গোপন তথ্য সংগ্রহ করে ছুটে আসতাম মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে। ধরা পরলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মাতৃভূমির টানে দেশের মানুষের প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এ তথ্যের উপর ভিত্তি করে কমান্ডো স্টাইলে আক্রমণ করা হতো পাক সেনাদের উপর। একাত্তুরের ১৪ নভেম্বর বকশিগঞ্জ-জামালপুর সড়কে এক এম্বুশে ৪টি পাকিস্তানী ১২০ মি.মি মর্টার এবং ৬টি গাড়ি ধ্বংশ ও বহু সংখ্যক পাকসেনা হত্যা করেছি। সবচেয়ে মজার ঘটনা হলো যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে বিষ মিশ্রিত এক ঝুড়ি কলা নিয়ে গিয়ে ছিলাম গাইবান্ধা ট্রেজারিতে। এখানে ছিলা হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। এ কলা খেয়ে অনেক পাকসেনা বিষক্রিয়ায় মারা গেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১-এর ৯ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার ক্লের তিনটি ব্যাটালিয়ান এবং আর্টিলারি রেজিমেন্ট নিয়ে জামালপুর পৌঁছে যান। ৩১ বেলুচের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ প্রায় ১৫০০ সৈন্য, এক ব্যাটারি (৬টি) ভারি মর্টার, ৬ পাউন্ডার গান নিয়ে জামালপুরে একটি দুর্গ প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। এ অবস্থান উচ্ছেদ না করে ভারতীয়দের দক্ষিণে অর্থাৎ টাঙ্গাইল, ঢাকার দিকে অগ্রাভিযান ছিল অসম্ভব অথবা করলেও হতো অর্থহীন। অপরদিকে এ শক্ত অবস্থানের ওপর আক্রমণের অর্থ প্রচুর লোকবলের ক্ষতি।
এ অবস্থায় বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের চিঠি লিখলেন লে. কর্নেল সুলতানের কাছে আতœসমপর্ণের আহব্বান জানিয়ে। কিন্তু সমস্য দেখা দিল কে নিয়ে যাবে এ চিঠি পাকিস্তানীদের কাছে। এসময় জহুরুল হক মুন্সি হাত তুললেন এবং বললেন এ চিঠি আমি পৌঁছাবো হানাদার ক্যাম্পে। সাদা একটি পতাকা উড়িয়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে গেলাম পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানে। শার্টের পকেটে ক্লের –এর চিঠি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বার্তা নিয়ে এসেছি শুনেই ওদের মাথায় রক্ত ওঠে গেল। এরপর সাদা পতাকা দিয়ে আমার চোখ ও গামছা দিয়ে আমার হাত বেঁধে ফেললো। জিপের পিছনে বসিয়ে স্পেয়ার চাকার সাথে শক্ত করে বাঁধা হলো আমাকে। নিয়ে গেল জামালপুর শহরের পিটিআই অফিসে কর্নেল সুলতানের কাছে। সুলতান চিঠি পওে ভারতীয় বার্তা বহনের অপরাধে হাতের এসএমজি’র বাটের এক আঘাতেই আমার মুখের উপরের পার্টির চারটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলল। সংগীদের হুকুম দিল ওকে শায়েস্তা করতে হবে। শুরু হলো আমার উপর অমানষিক নির্যাতন। আমার কাছ থেকে কথা বের করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। আহত অবস্থায় বুদ্ধি করে অসহায়ের ভান কওে বললাম আমি মুর্খ কৃষক ক্ষেতে কাজ করছিলাম এমন সময় ভারতীয়রা বাধ্য করেছে এ চিঠি নিয়ে আসতে। তারা এ চিঠি নিয়ে না গেলে আমাকে গুলি করে মারবে। এতে দয়া হল সুলতানের। পরে আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও এক কাপ চা দেওয়া হল। সুলতান কলম বের করে ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের-এর চিঠির জবাব লিখে চায়না রাইফেলের একটা গুলি মুড়িয়ে আমাকে দেওয়া হল ফেরত জবাব পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
শরীরের শেষ শক্তি ব্যবহার করে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে আমি যখন পৌঁছলাম তখন মাঝ রাত। সকলেই ধরেই নিয়েছিল আমি বুঝি আর বেঁচে নাই। পরদিন ভোরে পরিকল্পনা অনুযায়ী জামালপুর দখলের জন্য আক্রমণ শুরু হল। এসময় পাওয়া গেল ২৩৫ টি পাকসেনার মৃতদেহ, যুদ্ধবন্দি করা হল ৬১ জন ও আহতাবস্থায় বন্দি করা হল ২৩ জনকে। দখল করা হল বিভিন্ন ধরনের প্রচুর অস্ত্র। জামালপুর মুক্ত হল ১০ ডিসেম্বর। মেজর জেনারেল নাগরা এবং বিগ্রেডিয়ার ক্লেরসহ ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের এক সাহসী আতœপ্রত্যয়ী যুবকের দেশ প্রেম ও সাহস দেখে অভিভুত হলেন।
বাস্তব জীবনে তিনি ৩ ছেলে ও কন্যা সন্তানের জনক। ছেলেমেয়েদের বিয়ে সাদি দিয়েছেন। ছেলেরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা হয়েছে। মেয়েও স্বামী সন্তান নিয়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসীম সাহস ও বীরত্বের কথা গভীর শ্রদ্ধার সাথে জাতি যুগযুগ ধরে স্বরণ করবে কিংবদন্তি জহুরুল হক মুন্সিকে।