বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে একদিন আগে। তবে সারা বিশ্বের অধিকাংশ ফুটবলপ্রেমীর আসল বিশ্বকাপ শুরু হবে যেন তৃতীয় দিন থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সমর্থনপুষ্ট দল আর্জেন্টিনা যে মাঠে নামছে এদিন! প্রতিপক্ষ বিশ্বকাপের নবীন দেশ আইসল্যান্ড। যারা কি-না গত ইউরো কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছে রাশিয়ায়।
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে আর্জেন্টিনা দল নিয়ে তুমুল রহস্য। অনেকের কাছেই আর্জেন্টিনা রহস্যের কিনারা করা অসম্ভব হয়ে উঠছে। কেউ বলছে, এই দলটি নিয়ে এবার বাজি ধরা যাবে না। কারণ, বাছাই পর্বে যতটা ধুঁকেছে লা আলবিসেলেস্তেরা, তাতে তাদের নিয়ে বাজি ধরার সাহস অন্তত অনেকেই করছে না। বিশেষজ্ঞরা ফেবারিটের তালিকায়ও খুব বেশি রাখতে চাচ্ছে না।
কিন্তু তবুও বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ফেবারিট আর্জেন্টিনা। ১৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বিজয় মঞ্চে যদি লিওনেল মেসি বিশ্বকাপ শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরেন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হ্যাঁ, লিওনেল মেসি। বিশ্বসেরা ফুটবলার। মর্ত্যের পৃথিবীতে অন্তত মেসির চেয়ে এই মুহূর্তে আর কাউকে সেরা বলে স্বীকৃতি দেয়ার কেউ নেই। সেই মেসি, একাই একশো, এক হাজার কিংবা এক লক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। হতে পারেন ম্যারাডোনা কিংবা পেলে। যারা এককভাবে নিজের দেশকে বিশ্বকাপ শিরোপা উপহার দিয়েছেন। নিজের শেষ সুযোগকে কী কাজে লাগাতে চাইবেন না মেসি!
চাইবেন অবশ্যই; কিন্তু এই আর্জেন্টিনা দলটা যে পুরোপুরি রহস্যে ঘেরা। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ইনজুরিতে পড়ে অবশ্য তুনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ তীর নষ্ট হয়ে গেছে আর্জেন্টিনার। ছিটকে গেছেন পরীক্ষিত গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো। আরেক পরীক্ষিত মিডফিল্ডার ম্যানুয়েল লানজিনির ছিটকে পড়াটাকেই আর্জেন্টিনার জন্য সবচেয়ে বেশি আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কারণ, লানজিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডে নির্ভরতার প্রতীক। তাকে ঘিরেই আক্রমণের ছক আঁকছিলেন আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলি। অথচ, হুট করেই ইনজুরিতে পড়ে গেলেন তিনি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে গেলেন পুরো আর্জেন্টিনাকে। আরেক মিডফিল্ডার এভার বানেগাকে নিয়েও শঙ্কার কালো মেঘ। ইনজুরিতে পড়েছেন তিনিও। যদিও দলের সঙ্গে রয়েছেন এবং অনুশীলন করে নিজের আঘাতটাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন তিনি।
তবে, বাছাই পর্বে ধুঁকতে থাকা, কোচ হোর্হে সাম্পাওলির সময় কম পাওয়া এবং সবচেয়ে বড় কথা, একটি দল হিসেবে এখনও পর্যন্ত আর্জেন্টিনাকে তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতাই ভোগাতে পারে আর্জেন্টিনাকে। যদিও, মস্কোর উপকণ্ঠে ব্রোনিতসিকে ঘাঁটি গেঁড়ে প্রস্তুতি শুরু করার পর নিজেদের মধ্যে যে সমন্বয় তৈরি হয়েছে তা নিয়ে দলের তারকা ফুটবলার নিজেদের ফেবারিট হিসেবে দাবি করার সৎ সাহস দেখাতে পারছেন।
রহস্যটা এখানেই। শেষ মুহূর্তে কী তবে নিজেদের পুরোপুরি প্রস্তুত করে ফেলেছে আর্জেন্টিনা? সময়ই হয়তো সব বলে দেবে। তবে মেসির এই ঘোষণা প্রতিপক্ষ দলগুলোর জন্য অবশ্যই বড় একটি বার্তা বহন করছে।
সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে নবাগত আইসল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে কতটা প্রস্তুত আর্জেন্টিনা? এটা এখন দলটির সমর্থকদের মনে বিশাল এক প্রশ্ন। যেখানে আর্জেন্টিনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা সবাই রাশিয়া এসেছে নিজেদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে। কম করে হলেও দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে প্রতিটি দল।
সেখানে, আর্জেন্টিনার অবস্থা তো একেবারেই উল্লেখ করার মতো নয়। এমনিতে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার জন্য বড় কোনো প্রতিপক্ষকে বেছে নেয়নি তারা। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হাইতির সঙ্গে প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে মেসি অ্যান্ড কোং। যেখানে মেসি হ্যাটট্রিক করেছেন। তবে, সবচেয়ে বড় কথা, হাইতির বিপক্ষে আরও বেশি গোলে জিতলেও আর্জেন্টিনার প্রস্তুতিটা কেমন হয়েছে তা বোঝার উপায় ছিল না। কারণ, হাইতিকে উল্লেখযোগ্য শক্তির কোনো দেশ ধরা যায় না।
আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় প্রস্তুতি ম্যাচ ছিল ইসরায়েলের বিপক্ষে। জেরুজালেমে ওই ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ৯ জুন। ওই ম্যাচটি নিয়ে সারা বিশ্বেই তুমুল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যার কারণে শেষ মুহূর্তে ইসরায়েলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচটি বাতিল করতে বাধ্য হয় আর্জেন্টিনা। সুতরাং, একটি প্রস্তুতি ম্যাচ না খেলেই রাশিয়ায় পা রাখতে হয় আর্জেন্টিনাকে। যেটি খেলেছে, সেটিকেও ধর্তব্যের মধ্যে আনা যাচ্ছে না। সুতরাং, বলতে গেলে নিজেদের পরখ না করেই রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলতে চলে এসেছে আর্জেন্টাইনরা।
ইসরায়েলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচটা বাতিল হওয়ার কারণেই মূলতঃ আর্জেন্টিনা দলের মধ্যে একটা এলোমেলো অবস্থা তৈরি করে দিয়েছে। কোচ হোর্হে সাম্পাওলির একটি একাদশ যে দাঁড় করানোর সুযোগ পাওয়ার কথা ছিল, সেটা হলো না।
বুয়েন্স আয়ার্সে বেশ কিছুদিন পুরো দলকে এক সঙ্গে পেয়েছিলেন কোচ সাম্পাওলি। এরপর খেললেন হাইতির বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ। সেখান থেকে গিয়ে ঘাঁটি গাড়লেন স্পেনের বার্সেলোনায়। সপ্তাহের অধীক বার্সায় মেসিদের দল প্রস্তুতি ক্যাম্প করেছে। ইসরায়েল সফর বাদ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো দলবল নিয়ে সাম্পাওলি পৌঁছে গেলেন গ্রানিতসিতে।
দুই বছরে দুই কোচ। আর্জেন্টিনা ২০১৬ কোপা আমেরিকার পর থেকেই রয়েছে দারুণ সঙ্কটে। হোর্হে সাম্পাওলি দায়িত্ব নিয়েছেন বছর খানেক হতে চললো। যদিও, আর্জেন্টিনার ডাগআউটে দাঁড়ানোর মাত্র ১১ ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাশিয়ায় এলেন তিনি। যার মধ্যে জয় মাত্র ৬টিতে। ড্র তিনটি এবং পরাজয় দুটিতে। দায়িত্ব নেয়ার পর এত কম সময়ের মধ্যে আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে বিশ্বকাপে আসার রেকর্ড গড়েছেন সাম্পাওলি। তার আগে এই রেকর্ডটি ছিল ম্যারাডোনার। তবুও, ২০১০ সালে ম্যারাডোনা বিশ্বকাপে এসেছিলেন ১৯ ম্যাচের কোচিং অভিজ্ঞতা নিয়ে।
সাম্পাওলি যে দুটি ম্যাচে পরাজিত হয়েছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে স্পেনের বিপক্ষে ১-৬ পরাজয়ের ম্যাচ। এতবড় পরাজয়ের পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ভাগ্যটাই সবার কাছে সন্দেহের দোলাচলে চলে যায়। ওই ম্যাচে এত বড় পরাজয়ের পর আর্জেন্টিনা যে নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জোগাবে, সে সুযোগও পায়নি। কারণ, ওই ম্যাচের পর মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে মেসিরা। সেটি হাইতির বিপক্ষে।
তবুও, আর্জেন্টিনা দলটির আক্রমণভাগের দিকে তাকালে বিশ্বের যে কোনো দলেরই ঈর্ষা হতে পারে। লিওনেল মেসি তো রয়েছেনই। সঙ্গে সার্জিও আগুয়েরো। ম্যানসিটির হয়ে দুর্দান্ত একটি মৌসুম কাটিয়েছেন তিনি। রয়েছেন পাওলো দিবালা। ইতালিয়ান সিরি-এতে দারুণ এক পারফরমার। অনেকেই মেসির সঙ্গে তুলনা করেন তাকে। রয়েছেন গঞ্জালো হিগুয়াইন। বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার।
এছাড়া অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার হ্যাভিয়ের মাচেরানো, অ্যাঞ্জেল ডি মালিয়া, জিওভানি লো সেলসো, ম্যাক্সিমিলিয়ানো মেজা, নিকোলাস তালিয়াফিও এবং ক্রিশ্চিয়ান পাভনদের নিয়ে নবীন-প্রবীন মিশেলে দারুণ একটি স্কোয়াড সাম্পাওলির হাতে। মোট কথা, বিশ্ব জয় করার মত সব অস্ত্রই মজুত রয়েছে সাম্পাওলির হাতে।
শুধু সময়মত, পরিকল্পনা করে সেই মজুত অস্ত্রের ব্যবহার করতে জানতে পারার মধ্যেই নিহিত আর্জেন্টিনার সাফল্যের সব গোপন সূত্র। সেটা কী পারবেন সাম্পাওলি? ব্রানিতসিতে গিয়ে গত এক সপ্তাহের অনুশীলনে তিনি কী সেই মজুত অস্ত্রের ব্যবহারের সঠিক কোনো পরিকল্পনা করতে পেরেছেন?
যদি পেরে থাকেন, তাহলেই কেবল বিশ্ব কাপের বিশ্ব লড়াইয়ে শুধু আইসল্যান্ডিক গোপন বরফ পাহাড় টপকে যাওয়াই নয়, ১৫ জুলাই লুঝনিকির বিজয় মঞ্চে শিরোপাটা তুলে ধরলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সে আশাতেই বুক বাধছে পৃথিবীর শত কোটি আর্জেন্টিনা সমর্থক।