করোনাকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের ৫৯ শতাংশ কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় না। আর ৭৫ শতাংশের বেশি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যায় না। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ হার আরো বেড়েছে।
বিজ্ঞাপন
গত জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের করা ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিস-এবিলিটিজ (এনএসপিডি)’ শিরোনামের ওই জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০২১ সালের ১ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬ হাজার খানার ওপর জরিপটি চালানো হয়। জরিপের প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরা হলে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮ লাখ। প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যে বিবিএস বলেছে, প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নে নেওয়া পরিকল্পনা ও মূল্যায়নে এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় ৪০.৫৫ শতাংশ, আর যায় না ৫৯.৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যায় ২৪.৩৬ শতাংশ, আর যায় না ৭৫.৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রাথমিকে অংশগ্রহণকারী মেয়ে শিক্ষার্থী ৪০.৪৭ শতাংশ এবং ছেলে শিক্ষার্থী ৪০.৬৬ শতাংশ। মাধ্যমিকে অংশগ্রহণকারী মেয়ে শিক্ষার্থী ২৬.৬৪ শতাংশ এবং ছেলে শিক্ষার্থী ২২.৬৭ শতাংশ। আবার শহর ও গ্রামে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে রয়েছে তারতম্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাম ও শহর দুই জায়গায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বেশি হলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ কম। শহরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে ৪০.৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী, গ্রামে যাচ্ছে ৪০.৫৯ শতাংশ। আর গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে ২৫.২৩ শতাংশ এবং শহরে ২০.৭৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী।
বিভাগীয় পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হারে এগিয়ে সিলেট বিভাগ, পিছিয়ে বরিশাল বিভাগ, শতাংশের হারে যা যথাক্রমে ৬৫.৩৯ শতাংশ এবং ৩৩.৯৫ শতাংশ। বিভাগীয় পর্যায়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হারে এগিয়ে রংপুর, পিছিয়ে বরিশাল, শতাংশের হারে যা ৩৫.৫৩ শতাংশ এবং ১১.৩ শতাংশ।
প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সংখ্যা কম কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির (বি-স্ক্যান) সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীরা একাধিক কারণে বিদ্যালয়মুখী হতে চায় না। এর অন্যতম কারণ হলো বিদ্যালয়গুলো ভর্তি নিতে চায় না। অনেক মা-বাবাও সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। ’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া আমাদের স্কুলগুলোয় প্রতিবন্ধীদের জন্য দক্ষ শিক্ষকের অভাব। এসব বিষয়ে যদি সরকার নজর দেয় তাহলে শিক্ষার্থী আরো বাড়বে। আর প্রতিবন্ধী ভাতা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে অন্তত এক হাজার টাকা করা উচিত। ’
প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধীদের মাত্র ২৭.২১ শতাংশ কাজে নিযুক্ত। জরিপকালের আগের তিন মাসে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পায়নি ৩৮ শতাংশের বেশি। যারা সাধারণ চিকিৎসাসেবা পেয়েছে তাদের ২৭ শতাংশই পেয়েছে সরকারি হাসপাতাল থেকে। আর ৭২ শতাংশ প্রতিবন্ধীকে উচ্চমূল্যে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়েছে।
ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিস-এবিলিটিজের (এনএসপিডি) প্রকল্প পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম মনে করেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্কুলে না যাওয়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বেড়েছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা ৩৬ হাজার খানার ওপর জরিপ করে এই প্রতিবেদনে প্রাথমিক তথ্য দিয়েছি। খুব শিগগির পুরো ফল প্রকাশ করা হবে। এটি প্রথমবারের মতো করা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে জরিপ। ’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি করোনাকালে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যানও তাই বলছে। কিন্তু বাজেটে এদের নিয়ে তেমন কিছু দেখলাম না। উল্টো দেখলাম, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমেছে। ’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া উচিত, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে নয়। কারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা আছে। এর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী মানুষের ভাতা বাড়ানো সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। ’