চলতি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা ও উন্নয়নে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই পাশাপাশি দেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণে বাড়ছে অস্থিরতা, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা, বাড়ছে হতাহতের ঘটনা।
বাড়ছে পারিবারিক কলহপরিবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম মূলভিত্তি। এ সময়টায় বিভিন্ন কারণে পারিবারিক কলহের ঘটনা বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন হওয়ার ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীর কলহের জেরে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অভাব-অনটন, অর্থের প্রতি প্রবল দুর্বলতা, চাওয়া পাওয়ার অসঙ্গতির কারণে দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্য দেশের সংস্কৃতির আগ্রাসন, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, বিষণ্ণতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে সামাজিক অশান্তি বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে।
মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল জানান, সমাজে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেন না। মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। বেশিরভাগ সময়ে সে পরিবেশ তার কাছের মানুষরাই তৈরি করে দেয়। কখনও কখনও সমাজে মানুষদের আচরণ, অসহযোগিতার কারণে পরিবারে, সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণা বা মনোকষ্টে ভুগলে এসব হতে পারে। এজন্য কাউন্সিলিং দরকার। প্রত্যেককে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
একাকিত্ব থেকে অশান্তিবিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন জাহানারা জেরিন। ছোট্ট জেলা শহর ছেড়ে রাজধানীতে এসে স্বামীর সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন। স্বামী ফেরদৌস চাকরি করেন বড় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস। কিন্তু অফিসের ব্যস্ততা শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে চলে রাত ৮/৯টা পর্যন্ত। আবার যেহেতু সকালে অফিসে যেতে হবে তাই রাতে ঘুমাতে হয় ১১টার মধ্যে। এদিকে সারা দিন বাসাতে একাই থাকতে হয় জেরিনকে। ব্যস্ততার কারণে স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসা, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়ার সময় করতে পারেন না ফেরদৌস। এভাবেই কয়েক বছর ধরে চলছে জেরিন-ফেরদৌসের সংসার।
সারা দিনের একাকিত্ব আর স্বামীর টাইমের অভাব যেন জেঁকে ধরেছে জেরিনকে। দিনের পর দিন বাসায় একা থাকতে থাকতে যেন বিষণ্ণতা ভর করেছে তাকে। ইদানীং সোহেল নামের একজনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় জেরিনের। দু’জনের মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে তার। স্বামী যখন অফিসে থাকেন তখন তারা একে অপরের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক যুগান্তরকে বলেন, একাকিত্ব মানসিক বিষণ্ণতা সৃষ্টির অনেক বড় একটা কারণ। অনেক সংসারেই স্বামীরা বুঝতে পারেন না তার কাজের ব্যস্ততার কারণে স্ত্রীকে একদম সময় দেয়া হচ্ছে না। এজন্য অফিসে গেলে মাঝে মাঝে স্ত্রীকে ফোন দিতে হবে। মাঝে মাঝে কি করছে না করছে সেটির খোঁজ নিতে হবে।
অফিস থেকে আসতে দেরি হলে বাসায় জানাতে হবে। নিজের ব্যস্ততার বিষয়টি স্ত্রীকে বোঝাতে হবে। আবার স্ত্রীকেও স্বামীর ব্যস্ততা বুঝতে হবে। ব্যস্ততার মাঝেও সপ্তাহে অন্তত একটা দিন স্ত্রীকে নিয়ে বিনোদনের জন্য পার্ক বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। কোনো কারণে স্ত্রী যদি বুঝতে পারে তার স্বামী তাকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন না। তাহলে তাদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টিই হবে। একাকিত্বের ফাঁদে পড়ে মেয়েরা অনৈতিক কোনো সম্পর্ক বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।দাম্পত্য জীবনে অতৃপ্তি
বিয়ে বা সাংসারিক জীবনে কোনোভাবেই যৌনতাকে বাদ দেয়া যাবে না। বরং যৌনতাকে ঘিরেই দাম্পত্য জীবনে গতি আসে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো সংসারে অভাব-অনটন থাকলে যতটা অশান্তি হবে তার চেয়ে ভয়াবহ অশান্তি হবে যদি কোনো দম্পতির যৌন জীবন সুখের না হয়। পরকীয়া বা বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে আদিম কারণ শারীরিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা।
মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি, হতাশা বা দূরত্ব বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হল শারীরিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা। আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে জানে না, একটা মেয়েকে কীভাবে শারীরিকভাবে সুখী করতে হয়। অনেকেই জানেন না, আদিম এই খেলায় ছেলের পাশাপাশি মেয়েরও পরিপূর্ণতা বা সন্তুষ্ট হওয়ার একটা ব্যাপার আছে।
মেয়েদের অর্গাজম ঘটানোর ব্যাপারেও উদাসীন ছেলেরা। ছেলেদের যৌনজ্ঞানের অভাব মেয়েদের চরমানন্দ থেকে বঞ্চিত করে। এভাবে দিনের পর দিন মেয়েরা বঞ্চিত হতে হতে একটা সময় তাদের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা বা হতাশার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের ছেলেরা মনে করে মেয়েরা শুধু ভোগের বস্তু।
বিছানায় নিজের সন্তুষ্টি অর্জন হলেই সব শেষ। সঙ্গীর জৈবিক চাহিদার ব্যাপারে কোনো তোয়াক্কা নেই। এ রকম ঘটনা যে শুধু ছেলেদের ক্ষেত্রেই ঘটে সেটি নয়। অনেক মেয়েও তার সঙ্গীর শারীরিক চাহিদা পূরণে সচেতন, কিংবা আগ্রহী নন। এই শারীরিক অপূর্ণতাই পর-পুরুষ বা পর নারীতে আগ্রহের সৃষ্টি করে। কাজেই শারীরিক চাহিদা পূরণের ব্যাপারে উভয়কে সচেতন হতে হবে।
প্রেমের নামে ছলনাবেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন ফারিয়া (ছদ্মনাম)। রূপে-গুণে ফারিয়া অতুলনীয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অগণিত ভক্ত, ফ্যান-ফলোয়ার। এদিকে এই রূপের জালকে কাজে লাগিয়ে ফারিয়া একটার পর একটা প্রেম করেছেন। শুধু তাই নয় একসঙ্গে কয়েকটি প্রেম করছেন অনায়াসেই। তার সঙ্গে প্রেম করা ছেলেদের অনেকেই ফারিয়ার চরিত্রের বিষয়টি বুঝে বা না বুঝে শারীরিক সঙ্গ লাভের আশায় তার রূপের জালে জড়াচ্ছেন।
আমাদের আশপাশে একটু খেয়াল করলেই ফারিয়া বা তার মতো রোমিওদের দেখা পাওয়া খুব একটা কঠিন হবে না। সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসা ছিল। লাইলি-মজনু বা শিরি-ফরহাদের গল্পের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত।
কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে এসব ভালোবাসাবাসির সংজ্ঞা বদলে গেছে। বহু প্রেমে জড়াচ্ছেন অনেকেই। তরুণ-তরুণীদের একটা বড় অংশ একাধিক প্রেমে আসক্ত। আর বর্তমানে প্রেম মানেই অবাধে যৌন মেলামেশা। এই অবাধ যৌনাচার পরবর্তী সংসার জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কোনো কারণে স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হলে কিংবা শারীরিকভাবে সন্তুষ্ট হতে না পারলে পুরনো সঙ্গীদের শরণাপন্ন হন। অনেকে আবার অভ্যাগতভাবেই এসব অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ হন। কিন্তু এই বহুগামিতার ফলাফল আসলে ভালো নয়।ছাড় দেয়ার মন-মানসিকতা নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সমাজে বিচ্ছেদের বিষয়টি আদিকাল থেকেই আছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই হার অনেকটাই বেড়ে গেছে। আগে যখন কোনো বিয়ে হতো সেই সম্পর্কের দায়ভার দুই পরিবারসহ অভিভাবকরা নিত। বর্তমানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের অনেক মাধ্যম হয়েছে ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা নিজেই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পরিবার এসব বিয়েতে সম্মতি দিলেও দায়ভার নিচ্ছে না। ফলে পারিবারিক অশান্তি বা স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে মুখোমুখি দাঁড় করাতে হচ্ছে ছেলেমেয়েকে। এসবের কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পারিবারিক অনুশাসন মানার প্রবণতা কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের মেয়েরা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। কর্মক্ষেত্রের সর্বস্তরে মেয়েরা তাদের সাফল্যের পদধূলি রেখেছে। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক পুরুষ মেয়েদের কাজ করার বিষয়টি মেনে নেয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়নি। মেয়েরা যখন প্রেমিকা থাকে তখন তাদের প্রেমিকদের অনেক কিছুই মেনে নেয়। যেমন- ছেলেটি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করছে তুমি কার সঙ্গে খেতে যাচ্ছ, কি পরছ, এর সঙ্গে মিশবা, ওর সঙ্গে মিশবা না। মেয়েটি ভাবছে এটা হয়তো কেয়ারিং বা ভালোবাসারই একটা অংশ। কিন্তু এটাও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ। ছেলেটা যখন একই কাজ বিয়ের পর করছে তখন আর মেয়েটি মেনে নিতে পারে না। কর্মজীবী মেয়েরা অনেক সময় এসবের প্রতিবাদ করে। আর যারা পুরোপুরি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল বা কিছুক্ষেত্রে ছেলেরাও সমাজ-লোকলজ্জার ভয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আপস করেই একই ছাদের নিচে বসবাস করে। সাদেকা হালিম বলেন, সংসার জীবনে অনেক ধরনের উত্থান-পতন থাকতে পারে। অভাব-অনটন থাকতে পারে। প্রত্যেকের ছোট ছোট ভুল থাকতে পারে। এসব ছোটখাটো বিষয়ে ছাড় দিয়ে পথ চলতে হয়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, আমাদের অনেক বেশি চাহিদা। বিয়ের আগে মেয়েরা ছেলেদের অর্থ সম্পদের বিষয়টি খেয়াল করে। এটি ছেলেদের ওপর একটি চাপ। বাড়তি চাহিদার জন্য অনেকে অনৈতিক কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়ে।
নগরগুলোতে লিভ টুগেদার বাড়ছে
বর্তমানে একটি পরিচিত শব্দ লিভ টুগেদার। দু’জন অবিবাহিত নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী না হয়েও একসঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে থাকাটাই লিভ টুগেদার। এ ধরনের সংস্কৃতি মূলত বাইরের দেশেই প্রচলিত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতেও এই ধরনের অনৈতিক সম্পর্কে জড়াচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও আগ্রহী হয়ে উঠছে এ ধরনের সম্পর্কে। এতে করে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া না পাওয়া, অর্থ সংকট এবং জৈবিক চাহিদার কারণে এ ধরনের অনৈতিক কাজে উৎসাহী হচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা। ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের লিভ টুগেদার। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের অন্ধ আবেগ ও অনুকরণের পাশাপাশি জৈবিক চাহিদার কারণে তারা লিভ টুগেদার করছেন। আবার ঘন ঘন বিচ্ছেদও ঘটছে। সহসা আলাদা হয়ে যাচ্ছেন তারা। ঘটছে খুনের মতো অপরাধ। আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা-ডকুমেন্টারি ও নীল ছবি আমাদের সমাজমানসে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে, অনেকে সেটা গ্রহণ করছেন। সেই সঙ্গে সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের চিন্তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেও লিভ টুগেদারের হার বাড়ছে। আবার অনেক ছেলেমেয়ে মনে করছে লিভ টুগেদার করে কয়েক বছর কাটিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারা আবার অবিবাহিত পরিচয়ে সমাজে ফিরে যাবে, যাতে সমাজে তাদের মর্যাদা ঠিক থাকে। লিভ টুগেদারের কারণে সমাজে এক ধরনের অপরাধপ্রবণতা তৈরি হচ্ছে, কোনো কারণে বনিবনা না হলে খুন হয়ে যাচ্ছে মেয়ে বা ছেলেটি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পর্কের টানাপড়েন ও আবেগজনিত কারণে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ।