আজ সোমবার (১১ ডিসেম্বর) টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমপর্ণের মধ্য দিয়ে মুক্ত হয় টাঙ্গাইল। জানা যায়, ১৯৭১ সালের এই দিনে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও পলায়নের মধ্যে দিয়ে মুক্ত হয়েছিল টাঙ্গাইল।
সারারাত মুক্তিযোদ্ধাদের সারাশি আক্রমণ ও প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বিনিদ্র রাত কাটায় শহর ও শহরতলির লোকজন। অবশেষে সে কাঙ্খিত মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসে। ধবংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে স্বজন হারাদের বিয়োগ ব্যথা ভুলে হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতা রাস্তায় নেমে প্রাণের স্পন্দন আর মুক্তির আনন্দে উদ্বেল হয়ে নবজন্মের সেই মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে তোলে।
টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তানদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, জামালপুর এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি শামছুর রহমান খান শাজাহানের অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশি। একপর্যায়ে টাঙ্গাইলে গঠন করা হয় কাদেরিয়া বাহিনী। এই বাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাত শুরু করে পাক সেনাদের ওপর। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। শেষ পর্যন্ত এর সংখ্যা দাড়ায় ১৭ হাজারে।
৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে প্রায় পাঁচ হাজার পাক সেনা ও সাত হাজার রাজাকার আলবদর অবস্থান করে। খান সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যমুনা নদী পথে পাঠানো হয় সাতটি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
কাদেরিয়া বাহিনী গোপনে এই খবর পেয়ে জাহাজ ধবংস করার জন্য মাইন পোতার দায়িত্ব দেয় কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে। জীবনবাজী রেখে মাটিকাটা নামক স্থানে ঘটানো হয় জাহাজ বিস্ফোরণ। দু’টি জাহাজে দু’রাত দু’দিন ধরে চলতে থাকে অনবরত বিস্ফোরণ। বাকি জাহাজগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে।
মুক্তি বাহিনীর এ সব আক্রমণ, গোলাবারুদ ধ্বংস ও অস্ত্র উদ্ধারে খান সেনারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের। এসব যুদ্ধে তিন শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
টাঙ্গাইল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী অন্যান্য যোদ্ধাদের নিয়ে সখিপুরের মহানন্দা ও কীর্ত্তনখোলায় গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য দূর্গ। একের পর এক আক্রমণের মুখে পাক সেনারা গুটিয়ে জেলার অন্যান্য স্থান থেকে এসে যখন টাঙ্গাইল শহরে অবস্থান নেয় তখন উত্তর ও দক্ষিণ টাঙ্গাইল ছিল সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা করা হয় টাঙ্গাইল আক্রমণের। পরে কালিহাতীর পুংলি নামক স্থানে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সংর্ঘষ হয় পাক সেনাদের। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ ভয়ে পাক সেনারা সারারাত ধরে টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী চার দিক থেকে সারাশি আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে বিতারিত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী।
১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইলে প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক। ১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়োজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছান। আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান। সার্কিট হাউজে অবস্থানরত খান সেনারা কাদের সিদ্দিকীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।মুক্ত হয় টাঙ্গাইল জেলা।