বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। একের পর এক শিক্ষকের হাতে ছাত্রী হয়রানি-ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেই চলছে। এবার ছাত্রীর বাসায় ঢুকে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রভাষক মো. রকিবুজ্জামানের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ সামনে এসেছে। তবে অভিযোগ দেওয়ার দীর্ঘদিন হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এ ঘটনায় গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ওই ছাত্রী উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও সে বিষয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হেনস্তার মুখে পড়েন ছাত্রী।
ছাত্রীর ভাষ্য, ত্রিশাল পৌর শহরের একটি বাসায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। একই বাসায় ভাড়া থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রভাষক মো. রকিবুজ্জামান। ওই বাসার চারতলায় ভিকটিম ছাত্রী ও তিনতলায় প্রভাষক মো. রকিবুজ্জামান বসবাস করতেন।
ঘটনার দিন গত বছরের ২৮ অক্টোবর সকালে ওই ছাত্রী পড়াশোনা করার সময় জুনিয়র রুমমেট দরজা খুলে রেখে বাইরে চলে যায়। যে কারণে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। এসময় ওই ছাত্রী একাই বাসায় পড়াশোনা করছিলেন। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা পেয়ে হঠাৎ ফোকলোর বিভাগের প্রভাষক মো. রকিবুজ্জামান তার ফ্ল্যাটে ঢুকে কিচেন রুম, টয়লেট, বারান্দাসহ সব জায়গা ঘুরে দেখেন ওই ছাত্রী ছাড়া বাসায় আর কেউ নেই।
এ সময় ছাত্রীকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন। তখন ওই ছাত্রী হতভম্ব হয়ে শিক্ষকের কার্যকলাপ দেখছিলেন। শিক্ষক বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় দরজার ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করেও হঠাৎ পিছিয়ে গিয়ে ওই ছাত্রীকে জাপটে ধরে শরীরের বিভিন্ন জায়গা স্পর্শ করেন এবং আপত্তিকর কথা বলেন। তখন ওই ছাত্রী কান্নাকাটি শুরু করলে তিনি রুমের ছিটকিনি খুলে বের হয়ে যান। তখন ওই ছাত্রী দরজা বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী প্রফেসর তারানা নূপুরকে মোবাইলে বিস্তারিত বলেন।
এ সময় তার জুনিয়র রুমমেট ফিরে এসে দেখেন দরজা বন্ধ। দরজায় নক করলে দরজা খোলার পর ওই ছাত্রীকে কান্নাকাটি করতে দেখে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঘটনার বিস্তারিত বলেন।
ভিকটিম শিক্ষার্থী বলেন, অভিযোগ করার পর একদিন তদন্তের বিষয়টি জানতে প্রক্টর স্যারের কাছে যাই। প্রশাসনিক ভবনের সামনে আমি প্রক্টর স্যারের সঙ্গে কথা বলি। এসময় প্রক্টর স্যার বলেন, ‘ধর্ষণের চেষ্টা করছে, ধর্ষণ তো আর করেনি। এটা নিয়ে এতো তাড়াহুড়ো করার কী আছে।’ স্যারের এমন কথায় হতভম্ব হয়ে যাই। কীভাবে স্যার আমাকে এমন কথা বলতে পারলেন।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার তদন্তে দ্বিতীয়বার যখন আমাকে ডাকা হয়, তখন আমি তদন্ত কমিটির রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। তখন কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর জান্নাতুল ফেরদাউস স্যার এসে আমাকে বলেন, ‘মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছো, এমন অনেক ঘটনাই ঘটবে।
এগুলো যদি মানুষ জানে মানসম্মান তো তোমার যাবে। এগুলো নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। তাছাড়া ধর্ষণচেষ্টা করেছে, ধর্ষণ তো করেনি। এত তাড়াহুড়ো করার কী আছে?’
ঘটনা ঘটেছে অক্টোবরে, এত দেরি করে কেন অভিযোগ দিলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম, কী করবো? পরে বিষয়টি পরিবারকে না জানিয়ে আমার ভাবিকে জানিয়েছি।
এমন একটি ঘটনা আমার জীবনে ঘটলো আমি কোনো বিচার পাব না, এমন ভাবনা থেকেই অভিযোগ দিতে দেরি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) আমার চরিত্র হনন করার চেষ্টা করেছেন। অনেকে আমার চরিত্র নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করছে। এসব কারণে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যদি কোনো অঘটন ঘটে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তার দায়ভার বহন করতে হবে।
ওই শিক্ষার্থীর জুনিয়র রুমমেট বলেন, ঘটনার সময় আমি বাসার বাইরে ছিলাম। ফিরে এলে আপু আমাকে জানান। তবে, আমি স্যারকে বাসায় ঢুকতে বা বের হতে দেখিনি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী প্রফেসর তারানা নূপুর বলেন, ‘আমি সব সময় ছাত্রীদের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি কথা বলি। যে কারণে ছাত্রীরাও আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করে।
গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন ওই ছাত্রী আমাকে ফোন করে জানায়, ফোকলোর বিভাগের প্রভাষক মো. রকিবুজ্জামান তার বাসায় ঢুকে জাপটে ধরে ধর্ষণচেষ্টা চালিয়েছে। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, তুমি আগে নিজেকে সেফ করে আইনের সহায়তা নিতে পারো। তাছাড়া তখন তার পরীক্ষা ছিল।’
ওই বাসার মালিক সোহেল বলেন, ওই শিক্ষক স্ত্রীকে নিয়ে আমার বাসার তৃতীয় তলায় ও মেয়েটি চতুর্থ তলায় বসবাস করছিলেন। এমন ঘটনা শোনার পর বিভিন্ন চাপের কারণে শিক্ষককে অন্যত্র বাসা নিতে বলি। পরে তিনি আমার বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। এর চাইতে বেশি কিছু আমার জানা নেই।
এদিকে নিজের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর জান্নাতুল ফেরদাউস বলেন, না, এমন কোনো কথা আমি তাকে বলিনি।
তাছাড়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব। আমার কাজ হচ্ছে যৌন নিপীড়নের শিকার ছাত্রীদের তদন্ত কাজে ডেকে আনা। এছাড়া আমার সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সঞ্জয় কুমার মুখার্জী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি বিষয়টি তদন্ত করছে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি বলতে পারবে। এ বিষয়ে এর চাইতে বেশি কিছু আমার জানা নেই।
ওই শিক্ষার্থীকে বলা বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই শিক্ষার্থীকে আমি এমন কোনো কথা বলিনি। তাছাড়া অভিযোগ দেওয়ার দিনই তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। পরে তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও সংগীত বিভাগের অধ্যাপক মুশাররাত শবনম বলেন, ওই ছাত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আলাদা কোনো কমিটি হয়নি।
অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি তদন্ত করেছে। আমি যতদূর জানি তদন্ত শেষ হয়েছে। আমি ঢাকায় আছি, সেখান থেকে ফিরে ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রভাষক অভিযুক্ত মো. রকিবুজ্জামান বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এর চাইতে বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না। তবে এটা বলতে পারি, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, আমি যতদূর জানি তদন্ত শেষ হয়েছে। রিপোর্ট অচিরেই হাতে পাবো। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া ওই ছাত্রীকে ডেকে এনে কথা বলবো। তাকে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও হেনস্তার ঘটনায় দুই শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়। এরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রেজুয়ান আহমেদ শুভ্র ও একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহা। অধ্যাপক রেজুয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক ও সাজন সাহাকে চূড়ান্ত বহিষ্কার করা হয়েছে।