সরকারী নির্দেশনা মেনে করোনা প্রতিরোধে সবাইকে ঘরে থাকতে অনুরোধ করেছেন শেরপুরের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ। তিনি বলেন, “আপনারা চোর পুলিশ খেলা বন্ধ করুন। নতুবা শেরপুরে এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা মানবিক কারণে অনেক ছাড় দিয়েছি, তবে অবস্থার ভয়াবহতার কারণে কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
এদিকে শেরপুরে লকডাউন কার্যকর করতে প্রশাসনের সাথে মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানুষকে ঘরে রাখতে জেলা পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, আনসার ব্যাটালিয়ানের পাশাপাশি সচেতনতা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে করোনা ইমার্জেন্সি স্বেচ্ছাসেবী সাপোর্ট টিমের সদস্যরা। অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলেই গুনতে হচ্ছে জরিমানা। প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় শহরের মানুষ ঘরে থাকলেও পুরো উল্টো চিত্র শেরপুরের গ্রামগুলোতে।
শেরপুরে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা সনাক্তের সংখ্যা। সেই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। সংক্রমণ ও মৃতের আশি শতাংশই শহরে। তাই লকডাউনের এই সময়ে মানুষকে ঘরে রাখতে কঠোর অবস্থানে প্রশাসন। অকারণে বাইরে বের হলেই ভ্রাম্যমান আদালতের সাজা, গুনতে হচ্ছে জরিমানাও। জেলার পাঁচ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়ে বসানো হয়েছে পুলিশের চেক পোষ্ট। বাড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল।
শেরপুর পৌর শহরে করোনার সংক্রমণ রোধে পৌর কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে নিজ নিজ এলাকায় তৈরী করা হয়েছে রেসপন্স টিম। তাদের সাথে কাজ করছে রেড ক্রিসেন্ট ও জেলা প্রশাসনের করোনা ইমার্জেন্সি স্বেচ্ছাসেবী সাপোর্ট টিমের স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরাও। সবমিলিয়ে শহরের অবস্থা ভালো থাকলেও উল্টো চিত্র দেখা গেছে গ্রামে। জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সাময়িক প্রচারণা থাকলেও লকডাউন মানাতে বা মানুষকে ঘরে ফেরাতে তেমন কোন প্রদক্ষেপ চোখে পড়েনি গ্রামগুলোতে।
জেলা শহরের বাইরে প্রতিটি গ্রামেই এখনো উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক নেই বেশিরভাগ মানুষের মুখেই। দোকান খোলা রাখার পাশাপাশি জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে অনেকে। কোপা আমেরিকার ফাইনাল নিয়ে তুমুল ঝগড়াও দেখা গেছে বেশ কয়েকটি বাজারে। শুধু গ্রাম নয় জেলা সদরের বাইরে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী, নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলাতেও তেমন স্বাস্থ্যবিধি চোখে পড়েনি গত ছয়দিনে। লকডাউন নির্দেশনার প্রথম দিনে কিছুটা কঠোরতা থাকলেও বাকী পাঁচদিনে তেমন কঠোরতা দেখা যায়নি প্রশাসনের।
গতবছরের লকডাউনে জেলা পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয় থাকলেও এবার তেমন কোন প্রদক্ষেপ চোখে পড়েনি পুলিশের কার্যক্রমে। এদিকে শহরের করোনা সনাক্তের বাড়ি ও তার আশপাশে নিরাপত্তা দিতে কাজ করেছে পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগের টহল ছিলো চোখে পড়ার মতো। ট্রাফিক বিভাগের প্রতিটি পয়েন্টে স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ থাকায় শহরে খুব বেশি যানবাহনের দেখা মেলেনি। তবে গ্রাম এলাকায় করোনা প্রতিরোধে তেমন সচেতনতার বার্তা ও প্রশাসনের নজরদারি পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
রাত নয়টা অব্দি খোলা থাকে বেশির ভাগ গ্রামের বাজার। চলে চায়ের ষ্টলের আড্ডাও। করোনা কিভাবে ছড়ায়, মেসি কয় গোল করবে, কোপা আমেরিকা জিতবে কে; এই নিয়ে তুমুল ঝগড়াও চোখে পড়েছে কয়েকটি চায়ের দোকানে। এমনকি বুধবার সকাল সাতটায় কোপা আমেরিকার আর্জেন্টিনার খেলা দেখতেও বেশ কিছু দোকানে ভীড় ছিলো বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
বাজিতখিলা বাজারের কলিম মিয়ার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, এখনো বেশির ভাগ চায়ের দোকান খোলা। প্রথমদিন পুলিশ এসে চায়ের চুলায় পানি ঢাইলা দিয়া গেছিলো। হেরপর থেকে আর আহে নাই। এহন সব দুহান আটটা নয়টা পর্যন্ত খোলা থাহে। ঝিনাইগাতীরর বাকাকুড়া বাজারের আকাশ মিয়া বলেন, ঝিনাইগাতী বাজারেও ম্যালা দুহান খুলা থাহে। তাই আমরাও খুলা রাখছি। গ্রামের দিকে করোনা নাই। আমরা গরীব মানুষরে করোনা ধরবো না। শ্রীবরদীর ভায়াডাঙ্গা বাজারের নুরে আলম বলেন, শ্রীবরদী থেকে ভায়ডাঙ্গা পর্যন্ত পুলিশ করোনার কারণে টহল দেয়া কঠিন। এই সুযোগে মানুষ এহনো বাইরে আসে, দোকানে আড্ডা চলে।
এদিকে উপজেলা শহরগুলোর স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। অনলাইন গেমসের জন্য কয়েকজন করে বন্ধুরা একসাথে মিলে আড্ডা ও খেলা এখন নিয়মিত ব্যপার। রাত দশটা পর্যন্ত বেশির ভাগ খোলা জায়গায় চলে অনলাইন গেমসের আসর। ভুক্তভোগী এক অভিভাবক মোকারম হোসেন বলেন, আমার দুই ছেলেরই স্কুল বন্ধ। গত লকডাউনে দুজনকেই মোবাইল কিনে দিতে হইছে। এবার লকডাউনে প্রতি রাতেই দুজন দশটা এগারোটা সময় বাসায় ফেরে। শুধু আমার ছেলে না এরকম অনেকের অবস্থা একই।
শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. একেএম আনোয়ারুর রউফ বলেন, শেরপুরের এই ভয়াবহ অবস্থায় সবার সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। সবাইকে সচেতন হতে হবে। নিজেদের প্রয়োজনেই ঘরে থাকতে হবে। নতুবা আমাদের অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে।
শেরপুরের পুলিশ সুপার হাসান নাহিদ চৌধুরী বলেন, শহরে মানুষের আধিক্য ও সংক্রমণের আধিক্যের কারণে শহরে বেশি ফোর্স মোতায়ন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা বিট পুলিশিং ও ওয়ার্ড লেভেলে পুলিশের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সেই সাথে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের নিয়েও আমরা সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, মানুষকে ঘরে রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ১৬টি টিম পুরো জেলায় কাজ করছে। এরবাইরে আমরা জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়েও পুরো জেলায় কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে মসজিদে ইমামদের মাধ্যমে এবং মসজিদের মাইকেও আমরা সচেতন করতে চেষ্টা করেছি। তবুও মানুষ বাইরে আসছে। মানবিক দিক বিবেচনা শেষে আমরাও এখন কঠোর হচ্ছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রামের মানুষ করোনার এই ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ঘরে থাকতে শুরু করবে।