‘রাইতে দিনে পহর পাইরা আত্তি খেদাই। পাহাইরা আত্তিগুলা আমগরো ধান খাইয়া শেষ কইরা দিলো। পাকা ধান নিয়া চিন্তায় আছি, কাটতে পারমু কিনা। ফসল ঘরে তুলতে না পারলে বউ পোলাপাইন নিয়া না খাইয়া থাহন লাগবো।’
এভাবেই কথাগুলো বললেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও স্থলবন্দর এলাকায় বন্যহাতির তান্ডবে অতিষ্ঠ প্রান্তীক কৃষক আব্দুর রহিম (৫০)। তিনি উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁও গারো পাহাড়ের সাতপাকের গোপে ১ একর ২ কাঠা জমিতে দেশীয় আগাম জাতের আমন ধান লাগিয়েছেন। ইতোমধ্যে ধান প্রায় পেকে এসেছে। এই পাকা ধান নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন কবে যেন বন্যহাতির দল তান্ডব চালিয়ে সোনার ফসল খেয়ে সাবার করে দেয়।
আব্দুর রহিম জানান, চলতি আমন মৌসুমে তার পাহাড়ি গোপে ক্ষেত লাগানোর পর থেকেই বাবা ছেলে মিলে বন্যহাতির অত্যাচার থেকে ফসল রক্ষা করতে দিনেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তার ধান ক্ষেতে বন্যহাতি ৩ বার তান্ডব চালিয়েছে। ফসল কাটার শেষ মুহুর্তে এসেও থামছে না বন্যহাতির তান্ডব। প্রায় প্রতিদিনই পাকা ধান খেতে আসছে প্রায় ৪০/৫০টি বন্যহাতির দল। গ্রামবাসীরা মিলে পাকাধান রক্ষা করতে ডাকচিৎকার, হৈ-হোল্লোর করে ও মশাল জ্বালিয়ে প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হাতির তান্ডবের কারনে পাকা ফসল ঘরে তুলতে না পারলে পরিবারের খাদ্যের যোগান কিভাবে দিবেন এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এলাকার কৃষকরা। আশপাশের জমির মালিক ও স্থানীয় কৃষক কামাল হোসেন, আসকর আলী, আব্দুস সাত্তার, হালিম উদ্দিন ও বর্গাচাষী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কৃষাণী জস্টিন সাংমা, সুচনা মারাক ও প্রমিলা সাংমা জানান, তারা দুইযুগ ধরে বন্যহাতির সাথে যুদ্ধ করে কোন রকমে টিকে আছেন। মাঝে মধ্যেই বন্যহাতির দল আক্রমণ করে তাদের জানমালের ক্ষতি সাধন করছে। এ থেকে রক্ষা পেতে তারা টং ঘর তৈরি করে ফসল পাহাড়া দিচ্ছেন।
এদিকে, রোববার (৩০ অক্টোবর) রাতে উপজেলার আন্ধারুপাড়া-ডালুকোনা গ্রামের পাহাড়িগোপে রোপিত লুইস নেংমিনজার ১ একর, জালাল মিয়ার ৪০ শতাংশ ও অজিত সাংমার ৪০ শতাংশ জমির আধাপাকা ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে বিনষ্ট করেছে বন্যহাতির পাল।
সুত্র জানায়, নালিতাবাড়ীর সীমান্ত এলাকার পাহাড়ি রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের পানিহাতা, তাড়ানি, মায়াঘাসি, কালাকুমা, নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁও, দাওধারা-কাটাবাড়ি, ডালুকোনা, পোড়াগাঁও ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, বুরুঙ্গা-কালাপানি, বাতকুচি ও সমশ্চুড়া পাহাড়ি এলাকায় রোপিত প্রায় ৮০০ একর জমিতে আমন ধান প্রায় পেকে এসেছে। আবার কোন কোন এলাকায় ধানকাটা শুরু হয়েছে। দুই যুগধরে বন্যহাতি তান্ডব চালিয়ে এসব এলাকার বাসিন্দাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে আসলেও সরকারীভাবে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি সরকারের বন বিভাগ থেকে বন্যহাতির দ্বারা নিহত পরিবারকে ৩ লাখ টাকা, আহতকে ১ লাখ টাকা ও ফসলের ক্ষতিগ্রস্থকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হচ্ছে।
ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা রেঞ্জকর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, চলতি আমন মৌসুমে বন্যহাতির তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের তালিকা করে ঢাকা পাঠানো হয়েছে। তাদেরকে সরকারীভাবে ফসলের ক্ষতিপুরন দেয়া হবে। এ বিষয়ে আমরা সব সময় সর্তক রয়েছি। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ও জানমাল রক্ষা করতে এলাকাবাসীকে আমরা সচেতন করছি।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর কবির বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতি বাড়ি-ঘর ও ফসলের মাঠে তান্ডব চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করে আসছে। ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের বিভিন্ন প্রনোদনাসহ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষক যাতে সোনার ফসল ঘরে তুলতে পারে সেজন্য হাতি আক্রান্ত এলাকায় আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছি।