‘একতরফা’ নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যকে ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’ বলে মন্তব্য করেছেন রুহুল কবির রিজভী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী বলেন, কৃষিমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে মহাসমাবেশে পুলিশি তাণ্ডব-হত্যাকাণ্ড, চলমান যত সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার-সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত। শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী হাটে হাঁড়ি ভেঙে স্বীকার করলেন, দেশের আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, কোর্ট-কাচারি, বিচার-আচার-সবকিছুই আওয়ামী মাফিয়া সরকারের হাতে বন্দি। সোমবার দুপুরে ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পূর্ণ মিথ্যা সাজানো মামলায় জেলে পুরে এবং সারা দেশে বাড়িঘরছাড়া করে তাড়িয়ে বেড়ানোর গোমর ফাঁস করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। রোববার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘নির্বাচনকে নির্বিঘœ-কণ্টকমুক্ত করার জন্যই বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। চিন্তাভাবনা করেই এ কাজ করেছি। তাদের জেলে না ভরলে দেশ অচল হয়ে যেত। হরতালের দিন গাড়ি চলত না। তিনি আরও বলেন, বিএনপিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তারা নির্বাচনে এলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া নয়, বলা হয়েছিল সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এমনকি এক রাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি রাজি হয়নি।’
বিএনপি নেতা রিজভী বলেন, বিচার বিভাগ আইনের গতিতে নয়, চলছে গণভবনের গতিতে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগকে কার্যত আওয়ামী লীগের একটি ইউনিটে পরিণত করা হয়েছে। পরীক্ষিত আওয়ামী লীগের নেতাদের বেছে বেছে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ১৫ বছর ধরে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও আইনের শাসনের আওয়ামী নমুনা কৃষিমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট হয়েছে। নির্বিঘেœ নির্বাচন করতে পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ২০ হাজার নির্দোষ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সারা দেশের নির্দোষ নেতাকর্মীদের কারাগারে গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে। জামিনের অধিকারও খর্ব করা হয়েছে। শেখ হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী) চাইলে গ্রেফতারদের এক রাতেই ছেড়ে দিতে পারেন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করলে এক রাতেই মুক্তি দেওয়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, কোনো আইনের শাসনের দেশে, এমনকি ডিক্টেটর-শাসিত অনেক দেশেও সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, এতে এটা প্রমাণ হয়-বর্তমান আওয়ামী মাফিয়া সরকার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ জুলুমের এক অদ্ভুত স্বৈরতান্ত্রিক এবং একনায়কতন্ত্রিক সরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এ সরকারকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকার লিপ্সায় চারবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিনা অপরাধে ফরমায়েশি রায়ে কারারুদ্ধ করে রেখে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেছে-একথাই শতভাগ সত্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটির পর একটি মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুর হিসাব রাখছেন দেশের জনগণ। এই নজিরবিহীন অবিচারের বিচার একদিন হবেই হবে।
রিজভী বলেন, বিচারব্যবস্থা আর আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গেছে। পৃথক কোনো সত্তা নেই। দেশে কোনো আইন নেই। সব শেখ হাসিনার (প্রধানমন্ত্রী) ইশারাই চলছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা দায়ের আর অর্ধকোটি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। কারাগারে নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে সরকারের ব্লুপ্রিন্টে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যে বাংলাদেশের জনগণ হতভম্ভ উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, প্রথিতযশা সাংবাদিক ও লেখক এমজে আকবর বাংলাদেশে এসে রোববার এক সেমিনার শেষে সংবাদ সম্মেলনে নিশিরাতের ভোট ডাকাত, ১৫ বছর বন্দুকের নলের মুখে জনগণের ঘাড়ে দৈত্যের মতো চেপে বসা গণবিচ্ছিন্ন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে স্তূতি আর প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। তার বক্তৃতা শুনে তার সম্পর্কে যারা অবগত, তারা রীতিমতো বিস্মিত-হতবাক হয়েছেন।
রিজভী বলেন, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য বাংলাদেশের জনগণকে অবজ্ঞা করার শামিল। ভারত কি তাহলে বাংলাদেশের জনগণকে উপেক্ষা করে শুধু আওয়ামী লীগকেই বন্ধুত্বের বন্ধনে আঁকড়ে রাখতে চায়? এমজে আকবরের মন্তব্য কর্তৃত্বসুলভ এবং বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছাকে অসম্মান করা। বাংলাদেশ কোনো স্যাটেলাইট স্টেট নয়। বাংলাদেশের জনগণ কোনো দেশের প্রোটেক্টরেট নয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাবঞ্চিত। চলমান আন্দোলন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং জনগণের মালিকানা জনগণকে ফেরত দেওয়া। আমরা তো ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাই না। বাংলাদেশি নাগরিকরা অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমমর্যাদার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াতে বিশ্বাস করে। জনগণ বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের ভোট চুরির দোসর হবে না ভারত। প্রতিবেশী হিসাবে এদেশের ১৮ কোটি জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পক্ষে ভারত দাঁড়াবে-এটাই এদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।