এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিক্রির জন্য শেরপুরে প্রস্তুকৃত ষাঁড় ‘ইউটিউবার’, ‘ময়না’, ‘চিরকুমার’, ‘জমিদার’, ‘রাজা’, ‘বাদশা’-সহ বাহারি নামের অনেকগুলোসহ অবিক্রিত রয়ে গেছে প্রায় ৩১ হাজার পশু। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্যমতে, এবার কোরবানি উপলক্ষে শেরপুরে বিক্রির জন্য প্রস্তুত ছিল ৮৪ হাজার ৪১৭টি পশু। কিন্তু জেলার ১৮টি পশুর হাটে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫২ হাজার ৭৩৩টি পশু। এতে ৩১ হাজারের কিছু বেশি পশু অবিক্রিত রয়ে গেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ আশা করেছিল জেলা থেকে কমপক্ষে ১৫-২০ হাজার পশু রাজধানীসহ দেশের বড় হাটগুলোতে বিক্রি হবে। কিন্তু তাদের সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা গরু বিক্রেতাদের কয়েকজন জানান, এবার হাটে-হাটে ঘুরেও তারা বড় গরুর ক্রেতার দেখা পাননি।
এবারের কোরবানি ঈদে শেরপুরের অনেক খামারির স্বপ্ন পূরণ হয়নি। লাভের আশায় পশু পালন করে ঈদে ন্যায্য মূল্য তো দূরের কথা, লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে চেয়েও ক্রেতা পাননি অনেকে। আবার কেউ কেউ হাট ঘুরে ঘুরে লোকসান দিয়েই বিক্রি করেছেন।
সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনী মুড়া গ্রামের উজ্জ্বল মিয়া বলেন, আমার তিনটা গরু নৌহাটা পৌর হাট, ঘাটপাড়ের আব্দুস সামাদ গরুর হাট, ঝগড়ার চরের গরুর হাট ও চেঙুরিয়া গরুর হাটে নিয়ে নিয়ে ঘুরছি। একটা বিক্রি হলেও নায্য দাম না ওঠায় বাকি দুটো ফেরত আনতে হয়েছে। ঈদের পরে লোকসান দিয়েই বিক্রি করেছি।
শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নের ঝিনিয়া গ্রামের ছামিদুল হক বলেন, গত দশ বছরেও গরুর এমন ঢল দেখেনি। আমার দুটো গরু কামারের চরের হাট, কর্ণজোড়ার হাট, ঝগড়ার চরের গরুর হাট ও চেঙুরিয়া গরুর হাট ও জামালপুর ঘাটপাড়ের হাটে নিয়ে নিয়ে ঘুরছি। গাড়ি ভাড়াও চলে গেছে অনেক। পরে লোকসান দিয়েই বিক্রি করেছি কারণ টাকার দরকার ছিল খুব।
শুধু গরু নয়, এবারের কোরবানির পশুর হাটে বড় ছাগলের চাহিদা ও দামও ছিল অনেক কম। ন্যায্য দামে ছাগল বিক্রি করতে না পেরে জবাই করে মাংস বিক্রি করেছেন অনেকেই।
শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের কাজিরচর গ্রামের মাহফুজ মিয়া জানান, কোরবানির পশুর হাটে দুটি ছাগল তুলেছিলেন তিনি৷ একটি বিক্রি হলেও আরেকটি স্বজনদের মধ্যে দাম নির্ধারণ করে জবাই দিয়ে গোশত বিক্রি করেন।
এদিকে জেলার বড় ও ক্ষুদ্র খামারি, ব্যবসায়ী ও ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নকলার পশুর হাটগুলোতে বড় গরুর ক্রেতা আসেন জেলার বাইরে থেকে৷ বিশেষ করে ঢাকা-গাজীপুর, সাভার ও ময়মনসিংহ থেকে। কিন্তু এবার পশুর হাটগুলোতে বাইরের পাইকারদের আনাগোনা একেবারেই কম ছিল। তাই বড় ও বেশি দামের গরুগুলো বিক্রি হয়নি।
সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের পশ্চিম কুমড়ী গ্রামের খামারি সুমন মিয়া। পেশায় তিনি একজন ইউটিউবার। তার ৩০ মণ ওজনের ষাঁড় ‘ইউটিউবার’-কে বিক্রি করতে পারেননি এবারের ঈদে। লালনপালনে যা খরচ করেছেন, ইউটিউবারের দাম তার চেয়ে অনেক কম। তিনি হতাশ কণ্ঠে আরও বলেন, ‘আর গরু পালমু না।’
শেরপুর পৌর শহরের কান্দাপাড়া মহল্লার তরুণ উদ্যোক্তা তাহমিদ ইসরাক অলিদ। তিনি ঈদে বিক্রির জন্য ৩টি ষাঁড় লালনপালন করেন। বড় ষাঁড়টির নাম ‘জমিদার’। এর ওজন ৩১ মণ। এছাড়া তার ‘রাজা’ নামের ষাঁড়ের ওজন ২৫ ও ‘বাদশা’ নামের ষাঁড়ের ওজন ২২ মণ। এবারের হাটে বড় গরুর চাহিদা ও ক্রেতা কম থাকায় ৩ হাট ঘুরে একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, লাভের আশায় গরু পুষে বোকা বনে গেছেন। তার ‘জমিদারে’র পেছনে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০০ টাকা খরচ হয়। ২ বছর আগে তাকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় ক্রয় করেন। শুধু খাবারের হিসাব করলে এ গরুর দাম হয় সাড়ে ৬ লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতারা এর দাম বলেন ৪ লাখ টাকা। রাজার দাম ৩ লাখ ও বাদশার দাম আড়াই লাখ টাকা বলার পর ক্রেতা না পেয়ে তিনটি ষাঁড়কেই তিনি বাড়ি নিয়ে এসেছেন।
“অনেক যত্ন করে আমার ষাঁড়টাকে লালন-পালন করেছি। চলাফেরায় আলাদা একটা ভাব থাকায় ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম ‘ময়না।’ চাহিদামতো দাম না ওঠায় এবার ঈদে গরুটি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এত কষ্ট করে বড় ষাড় লালন পালন করে লাভ কী? ক্রেতা পাওয়া যায় না। আমি আর কষ্ট কইরা বড় গরু লালন পালন করমু না।”
আক্ষেপ নিয়ে কাছে কথাগুলো বলছিলেন সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুরের পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বুরুঙ্গা মধ্যপাড়া গ্রামের খামারি আব্দুস সালাম।
সদর উপজেলার কামারেরচর হাটের ইজারাদার সুজন কর্মকার বলেন, এবার ইজারা নিয়ে টাকা ওঠাতে পারিনি। সাম্প্রতিক বন্যায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেই কোরবানি দেননি। আবার গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় খামারিদের গরু পুষতে অনেক বেশি খরচ হয়েছে। সেই তুলনায় দাম ছিল অনেক কম।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বছর জেলায় কোরবানির গরুর উৎপাদন ৮৩ হাজার ৪শ ১৭টি ছিল। আর চাহিদা ছিল ৫৫ হাজার ৪শ ৬৫টি। এছাড়া জেলার পাঁচটি জেলায় মোট ২৭টি কোরবানির হাট ও ৬টি অনলাইন প্লাটফর্ম চালু ছিল। কিন্তু তাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার পশু বিক্রি কম হয়েছে। জেলার উদ্বৃত্ত ১৫-২০ হাজার গরু বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যায়নি ও বিক্রিও হয়নি।
তিনি আরও বলেন, জেলায় বড় গরু কেনার মতো ক্রেতা কম। আবার খরচের হিসাব করে অনেকেই গরু বাইরে নিয়ে যাননি। আমরা নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছি, যেহেতু বড় ষাঁড়গুলো এখনো সুস্থ সবল আছে, তাই আশা রাখি যেকোনো মুহূর্তে বিক্রি হয়ে যাবে৷