বাংলার ইতিহাস কম বেশি সবারই জানা। এক কালে আজকের বাংলাদেশ শাসন করেছেন জমিদার, রাজা আর নবাবেরা। কালের বিবর্তনে তারা হারিয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এখনো আছে তাদের সরব উপস্থিতি। আর তাদের স্মৃতি হিসেবে আজো টিকে আছে অসংখ্য স্থাপনা। সেই সব স্থাপনার মধ্যে অন্যতম দর্শনীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্থাপনা হচ্ছে আহসান মঞ্জিল।
আহসান মঞ্জিলের অবস্থান পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। বর্তমানে যেটি ইসলামপুর নামে পরিচিত। এক সময় এটি ব্যবহৃত হতো ব্রিটিশ ভারতের উপাধিপ্রাপ্ত ঢাকার নবাব পরিবারের বাসভবন ও সদর কাচারি হিসেবে। আজকে নবাব নেই, নেই নবাবী প্রথাও! কিন্তু নানা উত্থান-পতন ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের অংশ হিসেবে আজো টিকে আছে “আহসান মঞ্জিল”। বর্তমানে এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর।
একাধিক হাত বদল ও অসংখ্যবার সংস্কার করা হয়েছে বর্তমান আহসান মঞ্জিলের। ইতিহাস থেকে জানা যায় আঠার শতকের প্রথমদিকে জালালপুর পরগনার (বর্তমান ফরিদপুর-বরিশাল) জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে “রংমহল” নামে চমৎকার একটি প্রমোদ ভবন তৈরি করেন। সে যুগের অসংখ্য সুন্দরী রমণীর স্থান হয়েছিল এই রংমহলে। দেশের বিভিন্ন স্থান এমনকি দেশের বাইরে থেকেও এসব সুন্দরীদের সংগ্রহ করা হয়েছিল। শোনা যায় ঢাকার তৎকালীন ফৌজদার রংমহলের এক সুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
শেখ এনায়েতউল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ নবাব আলীবর্দি খানের শাসনামলে রংমহলটি ফরাসি বণিকদের নিকট বিক্রি করে দেন আনুমানিক ১৭৪০ সালের দিকে। ফরাসিরা এখানে তাদের বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করে এবং ব্যবসায় প্রচুর লাভ করে। ফরাসিরা এই এলাকায় (বর্তমান যে অংশে আহসান মঞ্জিল আছে) উত্তর-পশ্চিম কোনায় “ল্যুসজাল্লা” নামে একটি চৌবাচ্চা নির্মাণ করে।
উপমহাদেশে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে থাকলে ফরাসিরা উপমহাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং তাদের ঢাকাস্থিত সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকার তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত জমিদার খাজা আলীমুল্লাহ ১৮৩০ সালে ফরাসীদের নিকট থেকে কুঠিটি ক্রয় করেন এবং সংস্কারের মাধ্যমে নিজ বাসভবনের উপযোগ্য করে তোলেন। নবাব খাজা আলীমুল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে নবাব আবদুল গনি ১৮৬৯ সালে প্রাসাদটির পুনঃ নির্মাণ শুরু করেন যা শেষ হয় ১৮৭২ সালে। নবাব আবদুল গনি তার প্রিয় পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’। ১৮৮৮ সালের ৭ই এপ্রিল ঢাকায় এক প্রলয়ঙ্করী টর্নেডো আঘাত হানে। এতে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। এরপর আহসান মঞ্জিল পুনঃনির্মাণ করা হয় এবং এই সময়েই রংমহলের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ সংযোজন করা হয়। তৎকালীন সময়ে গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকার সবচেয়ে উঁচূ স্থাপনা।
১৮৯৭ সালের ১২ই জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আবারো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয় এবং তা পুনঃনির্মাণের প্রয়োজন হয়।
১৯১৫ সালে নওয়াব সলিমূল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার পুত্র হাবিবুল্লাহ পিতার স্থলাভিষিক্ত হন কিন্তু ঋণের দায়ে একের পর এক জমিদারী পরগনাসমূহ হারাতে থাকেন। নওয়াবের অন্যান্য সন্তানেরা যার যার মত সম্পত্তি নিয়ে আলাদা হয়ে যান। নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল এর ফলে ধীরে ধীরে অবহেলায় ভবনটি পরিত্যক্ত হতে থাকে। ১৯৫৮ সালে নবাব খাজা হাবিবুল্লার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ঢাকার নবাব পদবির কার্যকারিতা ও সম্মান যেমন শেষ হয়ে যায় তেমনি অস্তমিত হয় আহসান মঞ্জিলের অতীত গৌরব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নবাব পরিবারের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা বিদেশে পাড়ি জমান। এদেশে যারা ছিলেন তারা এ বিরাট প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম ছিলেন না। এমতাবস্থায় ১৯৭৪ সালে নবাব পরিবারের উত্তরসূরীগণ আহসান মঞ্জিল নিলামে বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আহসান মঞ্জিলের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৪ সালের ২ নভেম্বর উক্ত প্রাসাদ ভবন নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিল করে সংস্কারপূর্বক এখানে জাদুঘর ও পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন।
ধারনা করা হয় আহসান মঞ্জিলই ঢাকার প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য। যেখানে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা হয় নবাবদের হাতে। এখানকার নবাবরাই এ দেশে প্রথম আধুনিক খেলাধুলা যেমন- ক্রিকেট, হকি ইত্যাদির প্রচলন করেছিলেন। তাদের উদ্যোগেই ১৮৯৯ সালে ঢাকায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব গঠিত হয়। ঢাকায় প্রথম পানীয় জলের সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রচলন এই নবাবদেরই অবদান। ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহ কবিতা, নাটক, গান ও গজল লিখতেন। জীবনের শেষ ৩০ বছর তিনি দিনলিপি লিখেছেন। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি আহসান মঞ্জিলে আতিথ্য গ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠক করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কার্যক্রমের সাক্ষী হচ্ছে আহসান মঞ্জিল। ১৯০৬ সালে এখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ঢাকায় তো বটেই, গোটা পূর্ববঙ্গেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো আহসান মঞ্জিল। স্থানীয়ভাবে ঢাকাবাসীদের কাছে এর পরিচিতি নবাববাড়ি নামে। ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রনাধীন হয় এবং এখানে জাদুঘর স্থাপন করা হয়। এরপর থেকেই সাধারণ মানুষের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে।
সমগ্র আহসান মঞ্জিলটি দুটি অংশে বিভক্ত। পূর্ব পাশের গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় প্রাসাদ ভবন বা রংমহল। পশ্চিমাংশের আবাসিক কোষ্ঠাদি নিয়ে গঠিত ভবনকে বলা হয় অন্দরমহল যেটি ‘জানানা’ নামেও পরিচিত ছিল। এর পূর্বাংশের দোতলায় বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, কার্ডরুম ও তিনটি মেহমান কক্ষ এবং পশ্চিম অংশে আছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। মাঝখানে গোলাকার কক্ষের উপর অষ্টকোণ বিশিষ্ট উঁচু গম্বুজটি অবস্থিত। একটি নাচঘর, হিন্দুস্থানী কক্ষ এবং কয়েকটি আবাসিক কক্ষ রয়েছে নিচতলায়, রয়েছে দরবারগৃহ ও ভোজন কক্ষ। পূর্বাংশে আছে ডাইনিং হল, পশ্চিমাংশে বিলিয়ার্ড কক্ষ, দরবার হল ও কোষাগার। প্রাসাদ ভবনের উভয় তলায় উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে প্রসারিত বারান্দা। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে আছে দু’টি মনোরম খিলান। উপরে ওঠার জন্য রয়েছে কারুকার্যময় কাঠের সিঁড়ি। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও সহজেই যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুরো ভবনের বারান্দা ও মেঝে তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে। ভবনের ছাদ কাঠের তৈরি।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এখন পর্যন্ত সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা ৪ হাজারের অধিক। এখানে ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টিতে গ্যালারি আকারে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয় নবাবদের ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, গার্হস্থ সামগ্রী, মুদ্রা, চিত্রকর্ম প্রভৃতি। এছাড়া ১৯০৪ সালের আলোকচিত্রশিল্পী ফ্রিৎজকাপের তোলা ছবি অনুযায়ী ৯টি কক্ষ সাজানো হয়েছে। সবকটি গ্যালারি ঘুরে পাশেই নবাববাড়ির পুকুর দেখে আসা যাবে। প্রতিদিন গড়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ১৫০০ থেকে ২০০০ দর্শনার্থী এখানে প্রবেশ করে থাকে।