জবেদা বেগম। বয়স ৫০। সমাজের কুসংস্কার আর দারিদ্যের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তার অদম্য ইচ্ছা আর নিরলস প্রচেষ্ঠায় এগিয়েছেন অনেক দূর। তবে তার প্রত্যাশাও আকাশ ছোঁয়া। এজন্য এখনো থামেনি তার এ যুদ্ধ। চালিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক কার্যক্রম। এখন তাকে বলা যায়, “অবহেলিত নারী ও শিশুদের এক সফলতার প্রতীক জবেদা বেগম”।
তার অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মেনেছে দারিদ্র্যতা। তিনি অভাব অনটন আর সামাজিক কুসংস্কারের সাথে যুদ্ধ করে সমাজ উন্নয়নে সফল হয়েছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন অসংখ্য নারী ও শিশুকে। সফলতার আলো জ্বালিয়েছেন আশপাশের শতাধিক নারীর জীবনে। জীবন যুদ্ধে সমাজকে আলোকিত করে যাচ্ছেন এ সংগ্রামী নারী জবেদা বেগম। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গোসাইপুর ইউনিয়নের বালিয়াচন্ডি দহেড়পাড় গ্রামের মতিউর রহমানের স্ত্রী জবেদা। তার স্বামীর সহযোগিতা আর তার নিরলস প্রচেষ্ঠায় আলোকিত হচ্ছে এলাকা অনেক গৃহবধু ও শিশু।
স¤প্রতি সরেজমিন গেলে কথা হয় এ বিপ্লবী নারী জবেদা বেগমের সাথে। তিনি তুলে ধরেন তার ফেলে আসা দুঃখ কষ্ট আর সফলতার কথা। তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণী পাশের পর তার বিয়ে হয়। স্বামীর বেকারত্বে সংসারে ছিল অভাব অনটন। এছাড়া প্রত্যন্ত এ গ্রামে তার পক্ষে আয় করার মতো কোনো মাধ্যম ছিলনা। তিনি সামাজিক কুসংস্কার অপেক্ষা করে বেড়িয়ে পড়েন এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে নেন সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ। পরে একটি এনজিও থেকে ৫হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়িতেই শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ।
এরপর তিনি মহিলা অধিদপ্তর থেকে শিখেন বাঁশ বেতসহ কুঁটির শিল্প। সেলাইয়ের পাশাপাশি বাঁশের বেঁড়া, কুলা, চালুন, ডুলি, মাছ ধরার খালুই, বোরুং, পাইরেসহ ইত্যাদি তৈরি করে বিক্রি করার কাজ। এভাবে বাড়তে থাকে তার আয়ের উৎস। গত ৭/৮ বছরের ব্যবধানে তার আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন হয়। পরিবর্তন ঘটে তার অভাবের সংসারের।
যেখানে আগে দিন কাঁটতো অভাব অনাটনে। এখন তার গোলা ভরা ধান। পুকুর ভরা মাছ। সংসারে এক ছেলে সরকারি চাকরিতে। আরেক ছেলে ও মেয়ে কলেজে পড়ালেখা করছে। তার নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিবেশী অবহেলিত ৩৬জন মহিলাকে নিয়ে গঠন করেন নারী উন্নয়ন সংগঠন। তাদেরকেও বিনামূল্যে করান নানা রকম প্রশিক্ষন। এভাবেই বাড়ে কর্মময় মহিলার সংখ্যা। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন স্থানীয় গৃহবধূরা।
বুধবার বিকালে কথা হয় ওই গ্রামের নারী ছালেহা বেগম, আয়শা বেগম, খোদেজা বেগম, আমেনা খাতুনসহ আরো অনেকের সাথে। তারা জানান, এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় স্বেচ্ছা শ্রমে তিনি শিশু ও বয়স্ক নারীদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করান। নারীদের অবসর সময়ে বই ও পত্রিকা পড়তে তৈরি করেন লাইব্রেরী। তিনি এখন দহেড়পাড় মায়ের দোয়া মহিলা উন্নয়ন সমিতি ও দহেরপাড় জবেদা মতিউর গণগ্রন্থাগারের সভানেত্রী।
তিনি এসবের পাশাপাশি বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ, যৌতুক, নারী নির্যাতন, অমানবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সমাজের অবহেলিত নারীদের সচেতনতা ও স্বাবলম্বী করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এ সাফল্য দেখে এখন তার প্রতিবেশি অনেক নারী স্বাবলম্বী। এমনি স্বাবলম্বী হওয়া বিধবা নারী মোমেনা বেগম জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে মেয়েকে নিয়ে অতি কষ্টে দিন কাঁটাতেন। জবেদা বেগমের পরামর্শে তিনি সেলাইয়ের কাজ শিখেন।
এরপর বাশ বেতের কাজ শিখে বাড়িতে বসেই এসব কাজ করেন। তার আয় দিয়ে তিনি ছেলে মেয়েকে পড়া লেখা করাচ্ছেন। এখন তার আর কোনো অভাব নেই। কুসংস্কারের সাথে যুদ্ধ করে সমাজ উন্নয়নে সফলতা অর্জনকারী জবেদা বেগম বলেন, আমরা দহেড়পাড় গ্রামকে একটি মডেল গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এ গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ হলে ডিজিটাল গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন এ জীবন সংগ্রামী নারী।
শ্রীবরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজহুরা বলেন, উপজেলার দুইজন জয়িতার মধ্যে জবেদা বেগম একজন নির্বাচিত হয়েছেন। জেলার জয়িতা নির্বাচিতদের মধ্যে থেকেও সামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকায় এক অসাধারণ নারী হিসেবে তিনি বিভাগীয়ভাবে বাছাইয়ের তালিকা নির্ধারিত হয়েছে।