শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতির পাল অব্যাহত তান্ডব চালিয়ে খেয়ে সাবার করছে বোরো ফসল। একইসাথে ভেঙ্গে তছনছ করছে বসতবাড়ি। গ্রামবাসীরা ফসল রক্ষা করতে হৈ-হুল্লোড় করে ও মশাল জ্বালিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। ধানকাটা মৌসুমে টানা দুই সপ্তাহ যাবত পাহাড়ি এলাকার বিভিন্নস্থানে হাতির দলটি তান্ডব চালাচ্ছে। তারা এখন আর কোন বাঁধাই মানছে না। কৃষকের চোঁখের সামনেই খেয়ে সাবার করছে তাদের কর্ষ্টাজিত সোনার ফসল। শুক্রবার (৩ মে) রাতে বোরো ধানক্ষেত থেকে বন্যহাতি তাড়াতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা খলিল মিয়া (৪০) ও আলম মিয়া (৩৫) নামের দুই কৃষক আহত হয়েছেন। তারা পাশ^বর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক দিন যাবত ৪০/৫০ টির বন্যহাতির পাল উপজেলার বাতকুচি টিলাপাড়া ও বুরুঙ্গা কালাপানি গ্রামে অব্যাহত তান্ডব চালিয়ে পাহাড়ের ঢালে আবাদকৃত পাকা বোরোধান ক্ষেত খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে চলেছে। হাতিরদলটি শুক্রবার রাতব্যাপী তান্ডব চালিয়ে পাহাড়ের ঢালে বসবাসরত বুরুঙ্গা কালাপানি গ্রামের রুপচাঁন মিয়া, নছর আলী, সোহেল মিয়া, জালাল উদ্দীন, সিদ্দিক মিয়া, রিয়াজুল, হাজী হোসেন আলী, বাবুল মিয়া ও চাঁন মিয়াসহ বেশ কয়েক জন দরিদ্র কৃষকের পাহাড়ের ঢালে আবাদকৃত বোরোধান ক্ষেত খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে বিনষ্ট করেছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত ৪০/৫০ টি বন্যহাতির পাল দিনের বেলায় মধুটিলা ইকোপার্কের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করে আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেই খাদ্যের সন্ধানে পাশ্ববর্তী বাতকুচি, সমেশ্চুড়া ও বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকার ফসলি জমিতে নেমে আসে। হাতির দল বোরোধান ক্ষেত খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে বিনষ্ট করছে। এসময় ধানক্ষেত থেকে হাতিগুলোকে তাড়া করলে হাতি আর মানুষের মাঝে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। কোন কোন সময় ফসলের মাঠ থেকে তাড়িয়ে দিলে তখন বসতবাড়িতে গিয়ে তান্ডব চালায়। বাড়িতে রোপিত কলাগাছ, সুপারি গাছ ও নারিকেল গাছসহ সবজি আবাদ খেয়ে সাবার করে দিচ্ছে। গারো পাহাড়ে এ যেন এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হয়েছে। এদিকে, গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা তাদের জানমাল রক্ষা করতে রাত জেগে মশাল জ্বালিয়ে ডাক চিৎকার করে ও পটকা ফুটিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। হাতিগুলো এখন আর তেমন ভয় পায় না। এমনকি কোন বাঁধাই মানছে না। গত ২৫ এপ্রিল ওই এলাকার বাতকুচি গ্রামের উমর আলী মিস্ত্রি নামের এক কৃষককে পা দিয়ে পিষে নিহত করেছে বন্য হাতি। এরপর থেকে এসব এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছ। বন্যহাতির দল এখন কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে একযোগে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় তান্ডব চালাচ্ছে। গ্রামবাসীরা জানান, এই বন্যহাতি গুলো প্রায় দুই যুগ আগে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বংশ বিস্তার করে এর দল দিন দিন বড় হচ্ছে। এরা বাংলাদেশে অবাধে চলাচল করে গারো পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করছে। গ্রামবাসীরা দল বেঁধে হৈ-হুল্লোড় করে ঢাকঢোল পিটিয়ে শব্দ করে উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের দিকে তাড়িয়ে দিলে ভারতীয় বিএসএফ কাটা তারের বেড়া ও গেইট বন্ধ করে দেয়। তাদের কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বন্যহাতি আর ভারতে প্রবেশ তথা ফেরত যেতে পারছে না। ফলে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনভাবে চলাচল করে মাঝে মধ্যেই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করছে। এ নিয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে মানুষ তার বন্যহাতি দ্ব›দ্ব চলছে। মানুষও মরছে হাতিও মরছে। কিন্তু এর কোন স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। তারা বলেন, ভারত বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের যৌথ বৈঠকের মাধ্যমে বন্যহাতির সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করা দরকার। ময়মনসিংহ বনবিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যহাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার বিশেষ করে কেউ নিহত হলে ৩ লাখ, আহত হলে ১ লাখ ও ফসলের ক্ষতির জন্য ৫০ হাজার টাকা করে সরকার ক্ষতিপুরণ দিচ্ছে। তাই বন্যহাতিকে উত্যক্ত না করে সকলকে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করার পরামর্শ দেন তিনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, যে সকল কৃষকের ক্ষেতের ধান শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ পেকে গেছে তাদের ধান দ্রুত কেটে ফেলতে হবে। এতে কৃষকরা তাদের সোনার ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইলিশায় রিছিল বলেন, পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হচ্ছে। বন বিভাগের মাধ্যমে এসব ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া গারো পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতির তান্ডব থেকে জানমাল রক্ষার জন্য মশাল জ্বালাতে কেরোসিন তেল বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।