সারাহ ইসলাম। আলোকিত নাম। ২০ বছর বয়সি মেধাবী এই তরুণী ১৮ জানুয়ারি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মৃত্যুর আগে নিজেই পুরো দেহ দান করে গেছেন মানুষের কল্যাণে, গবেষণায়। তার চোখ দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখছেন দুজন। তারই কিডনি দিয়ে সুস্থ আছেন আরও দুই ব্যক্তি। কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার জীবন প্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই মাসহ পরিবার সদস্যদের কাছে তিনি দেহ দানের সিদ্ধান্ত নেন। সর্বশেষ ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করানো হয় সারাহকে। তিনি ১০ মাস বয়সে ‘টিউমার স্কেলেলিস’ রোগে ভুগছিলেন। এ মারণব্যাধি রোগ নিয়েই তিনি অগ্রণী গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন গোল্ডেন জিপি-৫ পেয়ে। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলভমেন্ট অলটারনেটিভে (ইউডা) ফাইন আর্টসে ভর্তি হন। সাহারা ফাইন আর্টসের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত বছরের অক্টোবর মাস থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তখন থেকেই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়। গত ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাকে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। রাত ১০টার দিকে অস্ত্রোপচার করে তার দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া অপসারণ করা হয়। ওইদিন কর্নিয়া ও কিডনি চারজন রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনও হয় গত ১৯ জানুয়ারি। এদিকে সকাল ৮টায় বিএসএমএমইউ’র কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে প্রয়াত সারাহর জানাজা শেষে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে দাফন করা হয়। সারাহর এমন আত্মদানে চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস জমাচ্ছে। চিকিৎসগণ বলছেন, সারাহর মতো মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করা হলে মানুষের কল্যাণ হবে। মানুষ বেঁচে যাবে। পৃথিবীর আলো দেখবে। এদিকে সারাহর পরিবারও মেয়েকে নিয়ে গর্ব করছেন। রাজধানীর হাতিরপুল ভূতের গলির একটি অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন সারাহ ইসলাম। শনিবার সন্ধ্যায় ওই বাসায় প্রবেশ করতেই চারদিকে শোকের পরিবেশ। দেয়ার ছাড়াও ঘরময় সারাহর স্মৃতির ছবিগুলো যেন বেদনাবিধুর ছড়াচ্ছে। শোকগাথায় মোড়ানো পুরো বাড়ি। সবার চোখে জল। মা ভাবছেন ওই যে সারাহ এলো বুঝি, মা আমার ডাকছে...। কিন্তু না। সারাহ নেই। মা এবং পরিবারের স্বজনদের এ রকম নানা স্মৃতিকথায় ততক্ষণে প্রতিবেদকের চোখের কোনায়ও জল ছলছল। মা শবনম সুলতানা বললেন, ‘আমার ফ্ল্যাটের প্রতিটি রুমে সারাহ আলো ছড়াচ্ছে। আমার মেয়ে বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তার ভেতরে থাকা রোগটা সম্পর্কে জানত। সে বেশি দিন বাঁচবে না, এটাও তার জানা। কিন্তু সারাহ প্রতিটা সময় আনন্দ নিয়ে বেঁচেছেন। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। তিনি গত ৩/৪ বছর ধরে বলে আসছিলেন, তার মৃত্যু হলে পুরো দেহ যেন দান করা হয়। সর্বশেষ মৃত্যুর আগে হাসপাতালেও আমার কাছ থেকে সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন। মায়ের হাতে ধরে দাবি আদায়ে মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের কী আতি তা ভাষায় বোঝানো যবে না। সারাহর আবেদন ছিল তার দেহ যেন মানবকল্যাণ, চিকিৎসা ও গবেষণার জন্য দান করা হয়। বিশ্বাস করুন, আমার এ মেয়ে স্বর্গশিশু। এত বড় একটা কঠিন রোগ ছিল। অথচ সে যে কী আদর্শ মানুষ ছিল, মানবিক ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। সন্তানের এমন গৌরবময় আত্মত্যাগের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শবনম সুলতানা বলেন, ‘আমার মেয়ের দু’চোখ দিয়ে অন্ধ দুজন দেখছেন, দুই কিডনি দ্বারা দুজন মানুষ সুস্থ জীবন পেয়েছেন। এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কী হতে পারে। ওদের মাঝেই আমার মেয়েকে খুঁজে পাব।’ তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে আজ মানবকল্যাণের জন্য বড় একটি উদাহরণ হয়ে গেছে। মানুষ এমনটিই বলছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দোয়া করছে।’ তিনি জানান, সারাহর ইচ্ছা ছিল, ওর ব্রেন নিয়ে গবেষণা হোক। ওটা যেন করা হয়।’ সারাহর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অস্ট্র্রেলিয়া থেকে ছুটে এসেছেন খালা মিনা, খালাতো বোন তাপসী রাবেয়া। তাপসী বলছিলেন, সারাহ আমার ছোট, কিন্তু মনে হয় সে আমার থেকে অনেক বেশি জানত। তার ভেতর যে মানবিকতা ছিল, ভালোবাসা ছিল, তা এক কথায় অনন্য। খালার ভাষায়, রোগের কারণে তার মুখমণ্ডলে স্পট ছিল, আমরা স্পটগুলোকে উপহার মনে করতাম। কারণ, সারাহ একটি পূর্ণাঙ্গ আদশ মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে একবার কেউ কথা বললে, তাকে ভুলতে পারত না। মেজো খালা ইয়াসমিন সুলতানা কাঁদছিলেন। বলছিলেন, তার মা বৃদ্ধ মানুষ। গত ২ বছর আগে মারা গেছেন। সারাহ মাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। নানির সঙ্গে প্রায় ঘুমিয়ে থাকতেন। নিজে অসুস্থ হয়েও নানির দেখাশোনা করতেন। সারাহ সত্যিই স্বর্গশিশু : দেশে প্রথম মৃত্যু ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। তিনি বললেন, সারা সত্যিই স্বর্গ শিশু, স্বর্গ মানুষ। রোববার দুপুরে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের এই প্রতিবেদকের। বললেন, ২০ বছর বয়সি সারাহ যে নজির রেখে গেছেন তা মানুষ যুগ যুগ স্মরণে রাখবে। এর মধ্য দিয়ে অন্যরা আগ্রহী হবে। আমি মনে করি, সারাহকে বীরের মর্যাদা দেওয়া উচিত। তাকে আমি কাছ থেকে দেখেছি, সে সত্যিই স্বর্গ শিশু-স্বর্গ মানুষ। সারাহ চেয়েছিল তার পুরো দেহ যেন গবেষণায় কাজে লাগানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ৯টি বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায়, কিন্তু তা বাস্তবায়নে এখনও সক্ষমতা আসেনি। ভালো আছেন কিডনি-কর্নিয়া প্রতিস্থাপনকৃত চার ব্যক্তি : ১৮ জানুয়ারি রাতে বিএসএমএমইউ ও জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে দুই রোগীর দেহে দুটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। সারাহ ইসলামের একটি কিডনি দেওয়া হয় মিরপুরের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে। মিরপুরের বাসিন্দা শামীমা (৩৪) ও হাসিনা আক্তার নামের দুই নারীর দেহে এগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। চিকিৎসক বলছেন, তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগবে। মিরপুরের শামীমা আক্তারের স্বামী মনি মিয়া জানান, তার স্ত্রী ভালো আছেন। তিনি টানা চার বছর ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। সবশেষে সারাহর কিডনি আমার স্ত্রীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আল্লাহ কাছে শুকরিয়া। সারাহর পরিবারের প্রতিও আমরা ঋণী। সারাহর দুটি কর্নিয়া দুজনের চোখে লাগানো হয়েছে। একজনের অস্ত্রোপচার হয় বিএসএমএমইউতে আর বাকিজনের অস্ত্রোপচার হয়েছে সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে। কর্নিয়া দুটি বসানো হয়েছে ফেরদৌস আখতার (৫৬) ও মোহাম্মদ সুজনের (২৩) চোখে। কর্নিয়া দুটি বসানো হয়েছে শিক্ষিকা ফেরদৌস আখতার (৫৬) ও মোহাম্মদ সুজনের (২৩) চোখে। ফেরদৌসের অস্ত্রোপচার হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এবং সুজনের সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর দুজনই সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজন ও চিকিৎসকরা। ফেরদৌস আখতার পেশায় স্কুল শিক্ষক। বাড়ি পাবনায়। তার চিকিৎসা চলছে বিএসএমএমইউতে। তিনি জানান, এখন ভালো আছেন। পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েকদিন সময় লাগবে। ২০১৬ সালে ভাইরাসজনিত কারণে তার ডান চোখে মারাত্মক সমস্যা হয়। সাত বছর পর সারাহর কর্নিয়া প্রতিস্থাপন হয় তার চোখে। এখন তার ডান চোখ দিয়ে দেখতে পারছেন। যে চোখ সারাহর। সারাহকে আমি বহন করছি। চোখ খোলেই তার পরিবারকে দেখেছি। সুজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। গত তিন বছর ডোনার সংকটে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করতে পারেননি। জানালেন, সারাহ এ দান জীবনভর বহন করবেন। সারাহর পরিবারের প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সুজনের চোখের অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাশ। রোববার সন্ধ্যায়, ডা. রাজশ্রী দাশ যুগান্তরকে জানান, সুজন সুস্থ আছেন। শনিবার বিকালে তাকে রিলিজ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার আসতে বলা হয়েছে। সে বেশ ভালো দেখছে, সারাহর চোখে। কিডনি দানে অনীহা নয় : জানা যায়, বিএসএমএমইউ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রয়োজন এমন ৫০ রোগীর তালিকা করে বিএসএমএমইউ। এর মধ্যে অন্তত তিনবার মৃত ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের অনীহায় প্রতিস্থাপন করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলছেন, ‘কিডনি প্রদান এবং প্রতিস্থাপন বিষয়টি খুবই সম্মান ও মানবিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে আসতে হবে। মৃত ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে যদি কারও জীবন বাঁচে-এর চেয়ে উত্তম কাজ আর কী হতে পারে।’