সোমবার , ১৭ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - বর্ষাকাল || ১০ই জিলহজ, ১৪৪৫ হিজরি

আব্দুর রাজ্জাক আশীষ : আপাদমস্তক এক রাজনীতিক ও সামাজিক সংগঠক

প্রকাশিত হয়েছে -


রফিকুল ইসলাম আধার: বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক, আন্দামান ফেরত আমৃত্যু বিপ্লবী রবি নিয়োগী বলতেন, ‘রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। আর মানুষের কল্যাণই হচ্ছে রাজনীতি বা রাজনীতির মূল উপজীব্য’। রাজনীতি নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা দার্শনিকের মূল্যায়ন বা পুথিগত সংজ্ঞা উদ্বৃত না করে আমাদের বিপ্লবী রবি নিয়োগীর মূল্যায়নকেই রাজনীতির সহজ ও সাবলীল সংজ্ঞা বলে ধরে নিতে পারি। অন্যদিকে শেরপুরের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বাধীনতাউত্তর বাংলায় প্রয়াত খান বাহাদুর ফজলুর রহমান, খন্দকার আব্দুল হামিদ, বিপ্লবী রবি নিয়োগী, এডভোকেট আনিসুর রহমান, আব্দুল হাকিম সরকার, নিজাম উদ্দিন আহমদ, এডভোকেট আব্দুস ছামাদ, অধ্যাপক আব্দুস সালাম, ডাঃ সেরাজুল হক, ডাঃ নাদেরুজ্জামান, ডাঃ ছামিদুল হক, আলহাজ্ব জাহেদ আলী চৌধুরী, খন্দকার মজিবুর রহমান, সৈয়দ এমদাদুল হক হীরা, এডভোকেট হাবিবুর রহমান, এডভোকেট একেএম ছাইফুল ইসলাম কালাম, অধ্যক্ষ আবু তাহের ও শাহ আব্দুর রহিম চৌধুরীর (সুরুজ চৌধুরী) সাথে যে নামটি অবশ্যই স্মরণ করতে হয় তিনি হচ্ছেন সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সমাজ সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক আশীষ।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগে হাতেখড়ি হলেও পরবর্তীতে জাগো ছাত্রফ্রন্টের নেতা হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে উঠেন। এরপর থেকে আর থেমে থাকেননি। তৎকালীন মহকুমা পর্যায়ের ১৯৭৮ সালে জাগো ছাত্রফ্রন্টের আহবায়ক, ১৯৮০ সালে যুব দলের আহবায়ক ও পরবর্তীতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে এক পরিচিত নাম হয়ে উঠেন আব্দুর রাজ্জাক আশীষ। ওই সময়কালে জাগো ছাত্রফ্রন্ট ও যুব দলে তার সমসাময়িক নেতৃত্বের মধ্যে ফজলুল হক বাদশা ও সাইফুল ইসলাম স্বপন যেন ছিলেন একই সূত্রে গাঁথা। যে কারণে আশীষ যখন সভাপতি, ফজলুল হক বাদশা তখন সাধারণ সম্পাদক ও সাইফুল ইসলাম স্বপন ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। যুব দলের গ-ি পেরিয়ে মূল দল বিএনপিতে ৩ জনেরই অভিষেক হলে আশীষ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর ওইসময় ফজলুল হক বাদশা সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাইফুল ইসলাম স্বপন শহর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে আব্দুর রাজ্জাক আশীষ কখনও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবার কখনও সিনিয়র যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ওই অবস্থায় একসময় তিনি জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবেও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা বিএনপির সম্মেলনে কাঙ্খিত পদ সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের কোনটাই না পেলেও শেষ পর্যন্ত সিনিয়র সহ-সভাপতি হচ্ছেন- এমনটাই গুঞ্জন ছিল রাজনৈতিক অঙ্গণসহ সচেতন মহলে। কিন্তু বিধিবাম। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হওয়ার পূর্বেই তিনি আকস্মিক মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ১১ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

একসাথে যাত্রা আর বয়সিক কারণে আশীষ-বাদশা-স্বপন ত্রয়ী ছিলেন আলোচিত। তবে ক্ষমতার ঘাত প্রতিঘাতের কারণে ফজলুল হক বাদশা ও সাইফুল ইসলাম স্বপন বিএনপি টু জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি টু বিএনপিতে দৌড়ঝাপ করলেও আব্দুর রাজ্জাক আশীষ ছিলেন দলের আদর্শে অটুট ও বলীয়ান। রাজনীতি আর সমাজসেবাই ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের প্রধান উপাদান। একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক ও সমাজ সংগঠক বলতে যা বোঝায় তার পুরোটাই ছিল আব্দুর রাজ্জাক আশীষের মাঝে। সমাজের নানা ফেসাদ-দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-ঝাটি আর মামলা-মোকদ্দমাসংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তিতে সালিস বৈঠকে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সমাজের একেবারে হতদরিদ্র থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের মানুষের সমস্যার আলোকে যে লোকটিকে স্মরণ করলে সহজেই পাওয়া যেত তিনিই আশীষ। ধনী-গরিব থেকে শুরু করে খ্যাত-অখ্যাত সবার জানাযাতেই তার উপস্থিতি ছিল সর্বাগ্রে। এজন্য তিনি একজন ‘জানাযা পাগল’ মানুষ বা নেতা হিসেবেও ছিলেন সমধিক আলোচিত। ভিন্ন ধর্মের মানুষের মৃত্যুতেও তিনি ছুটে যেতেন। স্মরণ করলে হাত বাড়াতেন তাদের সহায়তাতেও। আর এজন্য দলমতের উর্ধ্বে ছিল তার অবস্থান। একজন সার্বজনীন নেতা বা সমাজ সংস্কারক হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল।

Advertisements

নিজ এলাকায় উত্তরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ শেরপুরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও ছিল তার বিশাল ভূমিকা। অহিংসক মনের অধিকারী এ মানুষটি প্রায় সবসময়ই থেকেছেন প্রাণোচ্ছ্বল, হাসি-খুশি। নিজের বক্তৃতায় ছিল যেমন বিশেষ চমক, কৌতুকময়তা, তেমনি তার বক্তৃতার ছিল একটি ভিন্ন স্টাইলও। অনেকেই তার বক্তৃতাকে প্রয়াত ডাঃ ছামিদুল হকের স্টাইল বলেও অবহিত করতেন। শহরের এমন কোন গ্রাম বা মহল্লা নেই যেখানে তার বিচরণ ছিল না। সেইসূত্রে প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই তার ছিল নিজস্ব অবস্থান। তেমনি কোন এলাকার ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠিকে জানা বা চেনার ক্ষেত্রে তার কোন জুড়ি ছিল না। অর্থাৎ কোন এলাকার রিকশাচালক, দিনমজুর থেকে শুরু করে কোন ধনী ব্যক্তিকে দাদা থেকে শুরু করে নাতির সম্পর্ক পর্যন্ত স্বনামে বলার যোগ্যতা তার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। মূলতঃ কেবল পদ-পদবির নেতা নন, সত্যিকার অর্থেই একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। যে কারণে প্রিয় সেই নেতার জানাযায় শেরপুরের ইতিহাসে রেকর্ডসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়।

রাজনৈতিক জীবনের একটি দীর্ঘ সময় বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী শেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান/মেয়র নির্বাচনে টানা ৫ বার অংশ নিয়ে মাত্র একবার বিজয়ী হতে পারলেও তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ে, জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ওই ৫টি নির্বাচনের মধ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে নিজাম উদ্দিন আহাম্মদকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যথেষ্ট সফলও হয়েছিলেন। মূল শহর থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা আর অলি-গলির নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট নির্মাণে ছিল তার রেকর্ড। আর তার জীবদ্দশার শেষ দু’টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হুমায়ুন কবীর রুমানের সাথে মাত্র ৫২ ভোট ও গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটনের সাথে ২৬৭ ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পরও তার মনোবল ও চলৎশক্তি ছিল একেবারেই অতুলনীয়। আমাদের চলমান নির্বাচন সংস্কৃতিতে নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ভিন্ন বলয়ের প্রার্থী ও সমর্থকরা যখন প্রায় ছায়াটা পর্যন্ত কেটে ফেলার অবস্থায় অবতীর্ণ হন, ঠিক তখন আব্দুর রাজ্জাক আশীষের বেলায় সেটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। কারণ এ নিবন্ধকার (রফিকুল ইসলাম আধার) তার ভিন্ন আদর্শের লোক হওয়ার পরও এবং সঙ্গত কারণে তার নির্বাচন করতে না পারার পরও নির্বাচনকালীন ও পরবর্তীতে তার মানসিক অবস্থাকে পাওয়া গেছে পূর্বের মতই স্বাভাবিক ও সাবলীল।

মোদ্দা কথা; রাজনীতি আর সমাজসেবায় আব্দুর রাজ্জাক আশীষের যে ত্যাগ ছিল, সে তুলনায় তার ব্যক্তিগত জীবনে প্রাপ্তি ছিল খুবই কম। অল্পের জন্য পুনঃপুন ক্ষমতার মসনদ হারানো আর নীতি-নৈতিকতা ও অর্থ-বিত্তের সমীকরণে রাজনৈতিকভাবে উপযুক্ত পদ-পদবি না পাওয়ার চরম অতৃপ্তির চাপা কষ্টের কোন বহিঃপ্রকাশ ঘটাননি কখনই। এজন্যই আশীষ কেবল বিএনপিরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজের উঁচু-নিচু স্তরসহ দলমত সবার। তার ব্যক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বা যেমন তাকে মানুষের মন থেকে মনে ঠাঁয় দিয়েছিল, ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরও তিনি আছেন সবার মাঝে এবং থাকবেন। আমাদের সমাজ এমন মানুষই চায়, এমন মানুষকেই প্রয়োজন। আর সেই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাতে যেমন দলের বা দায়িত্বশীলদের সদয় হওয়া প্রয়োজন তার পরিবার-সন্তান সন্ততিদের প্রতি, ঠিক তেমনি তার মতো মানুষ গড়তে প্রয়োজন তার স্মৃতিকে ধরে রাখা। এজন্য তার নামে শহরের কোন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ কিংবা অন্তত একটি প্রধান সড়কের নামকরণ হলে যেমন ভাল হয়, ঠিক তেমনি হয় তার মরণোত্তর মূল্যায়ন। আর সেটা হলে শেরপুরের সচেতন মহলও অভিনন্দন জানাবে নামকরণ বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষকে। তার মৃত্যুর শোকাতুর মুহূর্তে সেই প্রত্যাশা আমাদেরও।

লেখক : সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিক, শেরপুর।