শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত সোহাগপুর গ্রাম। এ গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। পাকহানাদর বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদররা এদিন হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সোহাগপুর গ্রামের ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষকে হত্যা করে। পাশবিক নির্যাতন করা হয় ওই গ্রামের নারীদের। সেই থেকে সোহাগপুর গ্রামের নামকরন হয় বিধবাপল্লী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সোহাগপুর গ্রামের গণহত্যায় পাকবাহিনীর হাতে প্রথম নিহত হন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের রমেন্দ্র রিছিল। তখন তার স্ত্রী ঝর্ণা দিও (৭৬) পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। বর্তমানে ওই গ্রামের অন্যান্য নির্যাতিত ১৪ জন বিধবা বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেলেও স্বীকৃতি মেলেনি ঝর্ণা দিও ও স্বামী রমেন্দ্র রিছিলের।
ঝর্ণা দিওর কন্যা লিন্ডা দিও জানান, তার মা অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের অভাবের সংসারে কেউ খোঁজখবর নেয় না। তার মা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। শরীরে পানি এসেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসার খরচ ও ঠিকমতো খাবারের খরচও চালাতে পারছেন না। ওষুধ ও ফলমূলসহ ভালোমন্দ খেতে চান মা। টাকার অভাবে এসব যোগার করতে পারেন না তিনি। ঝর্ণা দিওর মেয়ে লিন্ডা একটি বেসরকারি চাকুরি করতেন। মায়ের শারিরীক এমন পরিস্থিতিতে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে মায়ের বাড়িতে থেকে সেবা করছেন তিনি। লিন্ডা খুব দ্রæত সময়ের মধ্যে তার মায়ের বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চান। এখন তার মাকে চিকিৎসা ও খাবারেরর সহযোগিতা করলে তাদের খুব উপকার হবে বলে জানান।
লিন্ডা আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের তালিকা তৈরীর সময় মা ঝর্ণা দিও রাজধানী ঢাকায় ছিলেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সোহাগপুর গণহত্যায় প্রথম নিহত হন তার বাবা রমেন্দ্র রিছিল। কেবল ঢাকায় থাকার কারণে তার বাবার তথ্যের তালিকা প্রস্তুতের সময় কেউ তাদেরকে জানায়নি। তাই সোহাগপুরের সৌর জায়া স্মৃতিফলকে তাদের কোন নামও নেই। তার মা নির্যাতনের শিকার হয়েও পাননি বীরাঙ্গনার সীকৃতি ও সরকারিভাবে কোন সুযোগ সুবিধা। বিগত ২০২১ সালে মা ঝর্ণা দিও তার বাবা রমেন্দ্র রিছিলের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে স্বীকৃতির দাবী জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রাণালয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন খবর পাননি।
স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান তালুকদার বলেন, সোহাগপুর গণহত্যায় নিহত ১৮৭ জনের মধ্যে সর্ব প্রথম রমেন্দ্র রিছিলকে হত্যা করা হয়। এসময় তার স্ত্রী ঝর্ণা দিও নির্যাতনের শিকার হন। যখন সরকারীভাবে স্বীকৃতির কার্যক্রম চলছিল তখন ঝর্ণা দিও ঢাকা শহরে ছিলেন। এখানে না থাকায় তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। পরে তারা মন্ত্রাণালয়ে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছেন।
নালিতাবাড়ী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসাসিয়েশনের চেয়ারম্যান মি. কোপেন্দ্র নকরেক বলেন, ১৯৭১ সালে সোহাগপুরে পাকহায়েনার দল ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। এ নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি নারীরাও। তাদের নির্যাতনের শিকার হন গারো আদিবাসী রমেন্দ্র রিছিল ও তার স্ত্রী ঝর্ণা দিও। তারা এখনো কোন সীকৃতি পায়নি। আমি এ দম্পতিকে দ্রæত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি প্রাপ্তীর দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, আমাদের কাছে যে তালিকা আছে তার মধ্যে ১৪ জন বীরাঙ্গনা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। তারা সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। ঝর্ণা দিওসহ বাকী যারা আছেন তাদের নাম গেজেটভুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া রমেন্দ্র রিছিলের নামও শহীদদের তালিকায় অর্ন্তভুক্তির জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, জাতীয় সংসদের উপনেতা স্থানীয় এমপি বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রচেষ্টায় সোহাগপুরের প্রত্যেক বিধবা নারীকে প্রতি মাসে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ২০ হাজার টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ২ হাজার, বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক থেকে ৪০০ টাকা ও সরকারি বিধবা ভাতা হিসেবে ৫০০ টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেই বিধবাদের মধ্যে বর্তমানে বেঁচে আছেন ২৩ জন নারী। নির্যাতনের শিকার ১৪ জন নারীকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রাণাালয়ের ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন প্রকল্প’ মাধ্যমে সোহাগপুর গ্রামের গণহত্যায় স্বামী স্বজন হারানো ও নির্যাতনের শিকার ৩০ নারীর জন্য বীর নিবাস নামে পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।