ভারতের মেঘালয় ঘেঁষা গারো পাহাড়ের শেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে চাষ করা হচ্ছে লটকন। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লটকন। গাছের গোড়া, কাণ্ড ও ডালে ডালে ঝুলে আছে এই ফল। আর এসব মাঝারি আকারের লটকনের বাগান বিক্রি হচ্ছে এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। এ দিকে পাহাড়ি এসব এলাকায় লটকন চাষে যাবতীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছে কৃষি বিভাগ।
পাহাড়ের চাষিদের মধ্যে লটকন চাষে আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। বাজারে এ ফলের ব্যাপক চাহিদা এবং দেশি ফলের প্রতি মানুষের আকর্ষণের কারণে লটকন চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। পাশাপাশি খরচ কম ও অল্প সময়ে লাভজনক হওয়ায় বাড়ছে এই ফল চাষের আগ্রহ। বেশ কয়েকবছর আগেও এই সুস্বাদু ফল চাষে কৃষকদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে ব্যাপক চাহিদা আর ভালো লাভ দেখে তিন-চার বছর ধরে পাহাড়ের চাষিরাও শুরু করেছেন এ ফলের চাষ। বাড়ির আশেপাশে, পতিত জমিতে চাষিরা এখন এই ফলের চাষ করছে।
এদিকে অঞ্চলভেদে লটকনের রয়েছে বিভিন্ন নাম। বুবি, ডুবি, লটকা, নটকোনা, হাড়ফাটা, লটকাউ, কানাইজু, কিছুয়ান, আঁশফল প্রভৃতি নামে পরিচিত। তবে শেরপুরের পাহাড়ি এলাকায় লটকন বা ববি নামেই বেশ পরিচিত। স্থানীয় বাঙালিরা ফলটিকে লটকন নামে চিনলেও নৃ-গোষ্ঠীরা ‘পচিমগুল’, বা ‘ক্যানাইজুসি’ নামেও ডাকে।
ঝিনাইগাতী উপজেলার হলদীগ্রাম, কাংশা, বাকাকুড়া, কালিনগর, বাউসাসহ বিভিন্ন গ্রামে লটকনের ছোটবড় অনেক বাগান রয়েছে। এছাড়াও শ্রীবরদী উপজেলার বাবলাকোনা, হারিয়াকোনা ও বালিজুড়িতেও ছোট ও মাঝারি অনেক বাগান রয়েছে।
সম্প্রতি ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ে আম ও লিচুর বাণিজ্যিক চাষাবাদ হলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ থেকে পিছিয়ে আছে লটকন। আম ও লিচু চাষে পরিচর্যাসহ বেশি খরচ লাগলেও লটকন চাষে নেই তেমন খরচ। এ ফল চাষের জন্য বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় না। কম খরচে অধিক লাভের সুযোগ আছে লটকনে।
ঝিনাইগাতীর বাউসা গ্রামের লটকন চাষি ইউপি সদস্য হামিদুল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। শেরপুর টাইমসকে তিনি বলেন, ২০০৭ সালে নরসিংদীর বেলাবো উপজেলা থেকে ১২০টি চারা এনে রোপন করেছি। ২০১২ সালে ৩৫টি গাছে ফল আসা শুরু করে। এরপর ২০১৬ সাল থেকে সব গাছেই ফল আসা শুরু করে। এ বছর ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বাগান বিক্রি করেছি। পাইকাররা বাগানে এসে বাগান কিনে নেয়। এবং ফল গাছে আসার আগেই অগ্রীম কিনে নেই তারা।
শেরপুর টাইমসকে তিনি আরও বলেন, গাছগুলো বাড়ির পেছনে পতিত ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করি। গাছগুলো যখন বড় হয় তখন অনেকে বিরূপ মন্তব্য করে। অনেকেই বলে, জঙ্গলে আবার জঙ্গল লাগাইতেছে। তবে বাগান থেকে যখন লাখ টাকার লটকন বিক্রি শুরু করি তখন অনেক কৃষকের মধ্যে বাগান করার আগ্রহ তৈরি হয়। আমাদের এ গ্রামে এখন বেশ কয়েকটি বাগান রয়েছে। আশা করছি, আল্লাহর রহমতে সামনে আরও বেশি ফলন পাবো।
আরেক কৃষি উদ্যোক্তা আলাউদ্দিন শেরপুর টাইমসকে জানান, প্রত্যেক বছর তার বাগান থেকে লাখ টাকার লটকন বিক্রি হচ্ছে। এ বছরও একলাখ টাকা বিক্রি করেছেন। লটকন চাষে কোনো বাড়তি খরচ না থাকায় অধিক মুনাফা পাওয়া যায়। আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসছে চারা নিতে। তারা বাগান করার পরামর্শ নিচ্ছে।
শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ি গ্রাম বাবলাকোনা, হারিয়াকোনায় বেশ কিছু ছোটবড় লটকনের বাগান রয়েছে।
শ্রীবরদী ট্রাইব্যাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিংট্রং মারাকের সাথে কথা হয়। তিনি শেরপুর টাইমসকে বলেন, ‘ষড়ঋতুর আমাদের এ দেশে প্রাণপ্রকৃতি অতি মূল্যবান উপাদান। প্রাকৃতিক পরিবেশে আপন নিয়মে অনাদিকাল ধরেই উৎপাদিত হচ্ছে চেনা-অচেনা নানা জাতের ফল,ফুল ও নানান শষ্য। এদের কোনো কোনোটাকে আমরা চিনি আবার কোনটাকে চিনি না। লটকন এক দশক ধরে ভালোভাবে পরিচিত পেয়েছে। অনেকেই বাগান করছে। মাঝারি এক একেকটি বাগান পাইকাররা লাখ টাকায় কিনে নিচ্ছে। এতে একটা বাড়তি আয় হচ্ছে পাশাপাশি পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাও মিটছে।
ঝিনাইগাতীর ছোট গজনীর ইকলাস ম্রং শেরপুর টাইমসকে বলেন, ‘মিস্টি ফল লটকন এক সময় পাহাড়ের ঢালুতে আর ঝড়ার পাড়ে বনজ ফল হিসেবে দেখতাম। কিন্ত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে বাজারে ভাল ধরে বিক্রি হওয়ায় এর চাহিদা এখন অনেক বেশি। অন্যান্য ফসলে খরচ লাগলে লটকনে বাড়তি খরচ নেই। তাই পাহাড়ি সব গ্রামে বাড়ছে এ ফলের চাষ।
একই পাড়ার মিতু মারাক শেরপুর টাইমসকে বলেন, ‘আমারদের পাহাড়ে আম-লিচুর বাগান হলেও বাণিজ্যিকভাবে লটকনের তেমন বাগান নেই। ছায়াযুক্ত ও পরিত্যক্ত জায়গাতেও এ ফল ভালো উৎপাদন হওয়ায় দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠে ফলটি।’
শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী, ভায়াডাঙা, খোয়ারপাড় শাপলা চত্বর, নয়ানী বাজার, থানার মোড়সব বিভিন্ন হাট বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লটকনের আকারভেদে কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১৮০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে এসব লটকন।
এ ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে কথা হয় পুষ্টিবিদ তাসলিমা আক্তার উর্মীর সাথে। তিনি শেরপুর টাইমসকে বলেন, ত্বক, দাঁত এবং হাড় মজবুত করতে লটকন মৌসুমি ফলের মধ্যে অন্যতম। লটকন শরীরে ভিটামিন সি’র চাহিদা মেটায়। খনিজ, ভিটামিন এবং মিনারেলে ভরপুর এ ফলটি বেরিবেরি জাতীয় রোগ থেকেও মুক্ত থাকতে সহায়তা করে। এছাড়াও লটকনে আছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট এবং প্রোটিন। যা আপনার ত্বক সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। পর্যাপ্ত প্রোটিনের কারণে শরীর পায় তার প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস।চর্মরোগ এবং রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে লটকন। তাই মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি করে লটকন খাওয়া প্রয়োজন।
জেলা কৃষি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিবানী রাণী নাথশেরপুর টাইমসকে বলেন, ‘গারো পাহাড়ের মাটিতে লটকন চাষের প্রায় সব গুনাগুন রয়েছে। তাই এসব পাহাড়ি গ্রামে লটকনের আবাদ ভালো হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ঝিনাইগাতীর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়ুন দিলদার শেরপুর টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্ষা মৌসুমের অন্যতম ফল লটকন। শীতের শেষে লটকন গাছে ফুল আসে। জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেবর মাসের দিকে লটকন ফল পাকে। যে কোনো ফলের চেয়ে অনেক লাভজনক লটকন চাষ। এখন এ ফলটি বাজারে বেশ দেখা যাচ্ছে এবং দামও চড়া। চাষাবাদে কম খরচ, কম পরিচর্যা ও লাভজনক হওয়ায় এখানে লটকনের আবাদ বাড়ছে। কৃষি বিভাগ সব সময় চাষিদের পাশে থেকে পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে।’