গত ৩৫ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চা পান করাচ্ছেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামের দরিদ্র চা বিক্রেতা আছর অালী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। বর্তমানে বয়স ৫৫ বছর। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযুদ্ধের গৌরব-বেদনা আর আনন্দ-বিষাদকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছেন তিনি। পরিবারে সবার সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় গর্তে লুকিয়ে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক পৈশাচিক কার্যকলাপ।
তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করার। কিন্তু অস্বচ্ছলতার কারণে তার ইচ্ছাপূরণ হয়নি। তারপরও দমে যাননি। সামর্থ অনুযায়ী দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে বিনামূল্যে চা পান করানোর মধ্যে দিয়ে তিনি সম্মান দেখিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
বাজিতপুর গ্রামের মৃত ময়ান উদ্দিনের ছেলে আছর আলী। বাজিতপুর বাজারেই রয়েছে তার এই মুক্তিসেবা টি স্টল। কোনও মুক্তিযোদ্ধা তার দোকানে চা পান করার পর অনেক চেষ্টা করেও তাকে চায়ের বিল দিতে পারেন না।
আছর আলী জানান, প্রথমে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের পয়সায় চা কিনে খাওয়াতেন। এরপর ৩৫ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চা খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে সামান্য পুঁজি নিয়ে বাড়ির সামনে বাজিতপুর বাজার মোড়ে শুরু করেন এই চায়ের দোকান।
তিনি বলেন, যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, তাদের সেবা করার সাধ্য আমার নেই। তাদের সামান্য দুইটা বিস্কুট, এক গ্লাস পানি আর এক কাপ চা পান করিয়ে আমি আত্মতৃপ্তি লাভ করি। মুক্তিযোদ্ধদের সম্মানে সামান্য এ সেবা যেন আমর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে যেতে পারি এবং আমার পরিবারের সবাই যেন এ সেবার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে- এটাই আমার আশা।
আছর আলীর স্ত্রী অজুফা বেগম (৫০) জানান, স্থানীয় বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক ও সেবা থেকে ঋণ নিয়ে এ চায়ের দোকান ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক কষ্ট করে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। ঘরে বৃদ্ধ শাশুড়ি। সেও শয্যাশায়ী। তার ঔষধপত্র কিনতেই হিমসিম খেতে হয়।
আছর আলীর ৩ সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে মঞ্জু (২২) এ বছর ধনবাড়ী কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন। মেয়ে আশিকা (১৬) স্থানীয় বাজিতপুর স্কুল থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছে। ছোট ছেলে তানভির (১১) বাজিতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনির ছাত্র। বাড়ির ভিটা ছাড়া সম্পদ বলতে তার আর কিছুই নেই। চায়ের দোকানটাই তার একমাত্র সম্বল। তবুও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই সেবা করতে পেরে খুশি। আছর আলীকে চায়ের দোকানে সাহায্য করে তার ছোট ছেলে তানজিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এ সেবা করতে পেরে তানজিলও অনেক খুশি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মাস্টার ও শাহজাহান আলী জানান, দরিদ্র আছর আলীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ত্যাগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
ধনবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আনোয়ার হোসেন কালু জানান, আছর আলীর এ মানবতার জন্য অনেক জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে দেখার জন্য আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার এ সম্মান নজিরবিহীন।