সংসার চালাতে ৩৫ বছর ধরে নিজের কাঁধেই ঘানি টানেন দরিদ্র শাজন মিয়া ও তার স্ত্রী। মানুষকে খাঁটি তেল খাওয়াবেন বলে বংশপরম্পরায় তেল ভাঙার এ পেশায় আছেন তারা। আর দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত নিশ্চিত করতে প্রতিদিন ঘানির অবসরে রিক্সাও চালান পঞ্চষোর্ধ শাজন মিয়া।
প্রায় তিন যুগ ধরে শেরপুর সদরের পাকুরিয়া ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের শাজন মিয়া ও বেগম (শাজন’র স্ত্রী) দম্পতি নিজেদের ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে ঘানি টেনে আসছেন। ভিটেবাড়িটুকুই সম্বল তাদের। মানুষকে খাঁটি তেল খাওয়াবেন বলে বংশপরম্পরায় তেল ভাঙার এ পেশায় আছেন তারা। আর দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত নিশ্চিত করতে প্রতিদিন ঘানির অবসরে রিক্সাও চালান পঞ্চষোর্ধ শাজন মিয়া।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শাজন মিয়ার বাড়িতে একটি ঘানি গাছ রয়েছে। ঘানির জোয়াল কাঁধে অনবরত ঘুরেই চলছেন শাজন ও বেগম। এদিকে ঘানি ঘরের বাইরে কয়েকজন বোতল নিয়ে অপেক্ষা করছেন তেল নেওয়ার জন্য।
শাজন-বেগমদের হিসেব অনুযায়ী, এক হাজার টাকায় ১০ কেজি সরিষা কিনে তা ভাঙ্গিয়ে চারশ’ টাকা দরে তিন লিটার সরিষার তেল ও ৪০ টাকা দরে ছয় কেজি খৈল বিক্রি করেন তারা। আর এতে লাভ হয় ৪৪০ টাকা, যা প্রত্যেকের শ্রমমূল্য প্রতিঘন্টায় মাত্র ২২ টাকা দাঁড়ায়।
শাজন মিয়া বলেন, সহাল (সকাল) ৭টা থাইক্কা (থকে) বিহাল (বিকাল) পর্যন্ত একটানা ঘানি টাইন্না (টেনে) ১০ সের (কেজি) সরিষা ভাইঙা তিন লিডার (লিটার) তেল বের করা যায়। আর এ দিয়ে সংসার চালানো এহন মুশকিল। তাই ঘানির পাশাপাশি ইক্সাও (রিক্সা) চালাই।
শাজন মিয়ার স্ত্রী বেগম বলেন, আমার বাপ দাদারা এ ঘানি বাইতো। আমার মা নিজেও পরাই (প্রায়) ৫০ বছর ঘানি টানছে। ঘানি টানতে টানতে আমার মা’র একসময় শ্বাসকষ্ট অসুখ অয় (হয়)। এখন আমার মা আর ঘানি ঘুরাইতে পারে না। তাই আমি আর আমার স্বামী মিইল্লা (মিলে) ঘানি টানছি। আমগোর এডা (একটা) গরু থাকলে আর এতো কষ্ট করতে অইতো না। ট্যাহার (টাকা) অভাবে গরু কিনতে পারি না। ঘানি এহন (এখন) ঘুরাইলে বুহে (বুকে) ব্যথা করে। পা অবশ অইয়া (হয়ে) আসে।
চকপাড়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইউনিয়নে এই একটি বাড়িতেই ঘানি রয়েছে। শাজন মিয়া দরিদ্র মানুষ। গরু কেনার সামর্থ্য নেই তার। ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে স্বামী-স্ত্রী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন।
স্থানীয় ছাইফুল মিয়া বলেন, বেগমের বাবা আগে ঘানি টানতো। এটা তাদের বংশগত পেশা। গরু ছাড়া ঘানি টানা খুব পরিশ্রমের কাজ। তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তাই গরু কিনতে পারে না। কেউ তাদের গরু কিনে দিয়ে সহায়তা করলে এ পেশাটি টিকে থাকতো।
জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ইতিমধ্যেই শাজন-বেগম দম্পতির বাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরিদর্শন করেছেন। ওই পরিবারকে সহায়তার জন্য একটি গরু কিনে দেওয়া হবে এবং তাদের ঘরটি মেরামত করে দেওয়া হবে।