মেহেদীর রং মুছেনা যেতেই স্থান হয় হাসির মুখ। দারিদ্রের নির্মমতায় প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয় এ গৃহবধূ। তার স্বপ্নগুলো ঢাকা পড়ে কালো মেঘে। দু’বেলা খাবার জোটানো তার স্বামীর কষ্ট সাধ্য। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ। বাধ্য হয়ে হাসিও নেমে পড়ে স্বামীর পেশায়। জীবন যুদ্ধে ক’মাস পর থেকেই তার স্বামী হাফেজ উদ্দিনের সাথে সমানতালে বাঁশের বেড়া বুননে ব্যস্ত। তার আট বছরের শিশু কন্যা হাসিনাও স্কুল ছুটির পর সহযোগিতা করে। হাসির আত্মবিশ্বাস আর নিরলস প্রচেষ্টায় মাত্র ৩/৪ বছরের ব্যবধানে বদলে যায় সংসারের চাকা। তাদের সংসারে আসে স্বচ্ছলতা।
সম্প্রতি কথা হয় হাসির সাথে। তিনি শেরপুর টাইমস-এর প্রতিবেদক শাকিল মুরাদকে জানান, “আমরা দু’জনে দিনে ২/৩টি করে বেড়া বুনতে পারি। আয় হয় ৫/৬শ টাকা। এখন আর অভাবের কথা মনে হয় না”। তিনি তুলে ধরেন ফেলে আসা সুখ দুঃখের দিন গুলোর কথা। এ সময় ওঠে আসে তার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করার। কিন্তু তার বাবার দারিদ্রতার কারনে হয়নি। তাদের মধুময় দাম্পত্যে দুই মেয়ে। হাসিনা ও হাদিয়া। দু’জনকেই পড়াশোনা করিয়ে নিজের আশা পূরন করতে চায় হাসি।
তার স্বামী হাফেজ উদ্দিন বলেন, “মেলা ধকল গেছে। তয় এ কাজ করে আধা একর আবাদী জমি কিনছি। ফসল পাই। বেড়া বানাইয়া সংসারের খরচ করি। তার পরেও মাসে ৩/৪শ করে ট্যাহা (টাকা) জমা অয়”। হাসির মতো তার প্রতিবেশী গৃহবধুরাও বসে নেই। কেউবা আস্ত বাঁশ চেরাই করে শলা তুলছেন। কেউবা শলা দিয়ে কুলা, চালুন, মাছ ধরার বুরোং, পাইরে, খালইসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত। সবাই পরম নিষ্টার সাথে কাজটি করছেন।
বাঁশ শিল্পে শ্রীবরদী উপজেলার আলোচিত গ্রাম চাউলিয়া ও দহেড়পাড়। চাউলিয়া গ্রামেই গৃহবধূ হাসির বাড়ি। তার মতো এ দু’গ্রামের প্রায় সবাই এখন স্বাবলম্বী। এ জন্য গ্রাম দুটি বাঁশ শিল্পের দিক থেকে জেলা শহর পর্যন্ত পরিচিত। গ্রামবাসীদের মতে, জেলার বেশিরভাগ বাঁশের সামগ্রী তৈরি হয় সেখানে। চাউলিয়ার বৃদ্ধ ছাবের আলী বলেন, ‘বাপ দাদার আমল থাইকা বাঁশের কাজ করি। এইডা ছাড়মো কেমনে’ কিন্তু পূর্ব পুরুষরা কিভাবে এ পেশায় নেমেছে তা স্পষ্ট ধারনা তার নেই। তবে একশ বছরের বেশি সময় তাদের এ পেশার সঙ্গে পরিচয় বলে জানালেন তার মত অনেকেই। সম্প্রতি সরেজমিন গেলে ওঠে আসে এসব তথ্য।
জানা যায়, শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার চাউলিয়া, দহেড়পাড়, বালিয়াচন্ডি, কুরুয়া, বকচর, গড়খোলা, শিমূলচূড়া, ঝগড়ারচর, কর্ণঝোরাসহ ১০/১২টি গ্রামে বাঁশ শিল্পের কাজ হয়। এসব গ্রামে প্রায় এক হাজার পরিবার শুধুমাত্র বাঁশের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির ওপর নির্ভর করে সংসার চালায়। তবে ৯৫ ভাগ পরিবার চাউলিয়া ও দাহেড়পাড় গ্রামেই। অন্যসব গ্রাম গুলোতে কেউ কুলা, চালুন, হাতপাখা, ডোল, কেউবা ঢালা, বেড়, খাড়ি, খলই, টোপা, খাঁচা, বুরোং, হেঙ্গা, পাইড়ে, সিলিং, দরমাসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে। তবে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে বছরে কার্তিক-অগ্রাহয়ন ও চৈত্র-বৈশাখ মাসে। তখন কাজের চাপ থাকে বেশি। তাই গভীর রাত পর্যন্তও কাজ করেন। এসব তৈরি বা বুননের কাজে পুরুষের অপো মেয়েরাই বেশি পারদর্শী। চাউলিয়ার হাফেজ উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, হাবিবুর, গৃহবধূ মাজেদা খাতুন, আজিজল, আবু শামা, দহেড়পাড় গ্রামের জোবেদা বেগম, মতিউর রহমান, বিধবা আয়শা, গৃহবধু মাজেদাসহ অনেকে জানান, প্রতি মৌসুমে তারা প্রত্যেকে কমপে ২ লাখ টাকার করে পন্য সামগ্রী বিক্রি করেন। তাদের গ্রামের উৎপাদিত পন্য গ্রাম থেকেই পাইকারি বিক্রি হয়। পাইকাররা ভ্যান-পিকাপসহ বিভিন্ন যানবাহনে শহরে নিয়ে যায়। তাদের মতে, সরকারি-বেসরকারি ভাবে পৃষ্ঠ পোষকতা পেলে আরো আয় করা সম্ভব।