সারাদেশে প্রতি বছর সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ হারায় কয়েক হাজার মানুষ। আর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে কতজন তার সঠিক হিসাব নেই। স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিঁটকে পড়ে অস্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে এসব মানুষ।
সর্বশেষ মৃতের কাতারে যোগ হয়েছে আরো ১১ তাজা প্রাণ। রোববার সকালে সাড়ে ৮টার দিকে নরসিংদীর বেলাবোতে বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয় ওই ১১ জন। এ সময় আহত হয় আরো চারজন। এর আগে ফরিদপুরের নগরকান্দায় শুক্রবার রাতে গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে বেপরোয়া গতির যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন লেগে যায় দুটি গাড়িতেই। এতে পুড়ে মারা যায় ১৩ জন। এ ছাড়া শনিবার সারাদেশে আরো ১২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এভাবেই প্রতিদিন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে কারো না কারো আপনজন। আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে কেউ না কেউ। কিন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ হয় না। নিহতের সংখ্যাই যেখানে সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় না সেখানে আহতের তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমনটিই জানা গেল সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে। তাদের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেও এর প্রমাণ মিলেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত উদ্ধার এবং তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি। এ কারণে ঢাকাসহ সব সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় ট্রমা সেন্টার স্থাপন জরুরি। সেই সঙ্গে আহতদের উদ্ধারে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবক দল থাকা জরুরি।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আহতদের যথাসময়ে উদ্ধার এবং চিকিৎসার উদ্যোগতো পরের কথা, আমাদের দেশে দুর্ঘটনাজনিত কারণে কত সংখ্যক লোক আহত হন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণতো বৈশ্বিক হিসাবে একজন নিহত হলে তার অনুপাতে পাঁচ থেকে সাতজন আহতের ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর আমাদের দেশে এটার উল্টো। কখনো কখনো দেখা যায়, দু’জন নিহতের তথ্য পেলে আহতের তথ্য পাওয়া যায় একজনের।’
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘সরকারের কোনো সংস্থার কাছে যেহেতু তথ্য নাই সুতরাং অন্য কারো কাছে থাকারও কথা নয়।’
এর অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমাদের দেশে সংঘটিত দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা পুলিশ লিপিবদ্ধ করে। কিন্তু সব নিহতের হিসাব লিপিবদ্ধ করা হয় না। শুধু যেসব ঘটনার সঙ্গে মামলা বা জিডির প্রয়োজন হয় সেগুলোর হিসাব থাকে। সেক্ষেত্রে কিছু আহতের হিসাব থাকে। অধিকাংশ আহতের কোনো হিসাব থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে দুর্ঘটনার শিকার নিহতদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ মারা যায় ঘটনাস্থলেই। আর ৪৫ শতাংশ মানুষ মারা যায় অন্তত এক ঘণ্টা বা তারও কিছু পরে। এ সময়টাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে গোল্ডেন আওয়ার। এ সময়ের মধ্যে যারা মারা যায় তারা মূলত যথাসময়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, এ আহত লোকগুলোকে বাঁচানো যেতো যদি সময়মতো চিকিৎসার আওতায় আনা যেতো। এরাতো কোনো রোগী না। বরং সুস্থ মানুষ। শুধু রক্তক্ষরণ বন্ধ করে দিয়ে বা সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব।’
সড়ক দুর্ঘটনায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ৪১৬ জন নিহত ও এক হাজার ১২ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। তাদের দেওয়া হিসাবে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৫০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ৫৪ জন নারী ও ৫৫ জন শিশু রয়েছে।
মহাসড়ক, জাতীয় সড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। ২০টি জাতীয় দৈনিক, ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং ৮টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থার তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তাদের এ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র নিয়ে তৈরি পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা ২০১৬ সালে চার হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনা রেকর্ড করেছে। এ দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫৫ জন নিহত হয়েছে। একই ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৯১৪ জন, যা নিহতের আড়াই গুণ। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৭২২ জন। আর দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করেছে ৯২৩ জন।
সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে জুলাই মাসে। এ মাসে ৪৭৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে নিহত হয়েছে ৫৫৫ জন। আর আহত হয়েছে দুই হাজার ২৩ জন। আর সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে সেপ্টেম্বর মাসে। এ মাসে মারা গেছে ৫৬৮ জন।
নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) হিসাব মতে, গত এক বছরে (২০১৬) দুই হাজার ৩১৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে চার হাজার ১৪৪ জন। আহত হয়েছে পাঁচ হাজার ২২৫ জন। এখানে নিহত ও আহতের আনুপাত প্রায় আড়াইগুণ।
নিরাপদ সড়ক চাই’র দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৩ জন। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার প্রায় ১৭.১৬ শতাংশ কমেছে। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে দুই হাজার ৬২৬টি। আর আহত হয়েছিল ছয় হাজার ১৯৭ জন।
তবে নিরাপদ সড়ক চাই’র চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমাদের এ পরিসংখ্যান ছয়টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন ও আমাদের ঢাকার বাইরের স্থানীয় পর্যায়ের শাখার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক দুর্ঘটনায় বিশেষ করে ছোট ছোট দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয় যা পত্রিকায়ও প্রকাশ হয় না। এদের মধ্যে অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়, যা এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। সে হিসাবে আহতের সংখ্যা আরো বেশি হবে তাতে কোনো দ্বিমত নেই।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে হয় না। তবে সব দুর্ঘটনার খবর সংবাদ মাধ্যমে আসে না। আমরা সংবাদ মাধ্যমের খবরের সূত্র ধরে পরিসংখ্যান তৈরি করে থাকি। তাই সব ঘটনা, আহত-নিহতের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা যায় না।’
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা এ দুটি সংগঠনের প্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা সহমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দুর্ঘটনায় কত সংখ্যক লোক আহত হন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।’
সূত্র: পরিবর্তন ডটকম।