‘আমার একি সর্বনাশ অইয়া (হয়ে) গেলো। আমার ভাগ্যে এইডা (এটা) কি ছিলো। কতশত স্বপ্ন দেখছিলাম সংসার সাজানো নিয়ে, স্বপ্ন শুরুর আগেই ভেঙে গেল। আমার ত সবশেষ অইয়া গেছে, আমি কিভাবে জীবন কাডামু (কাটামু)।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নববধূ রিতু।
মাত্র পাঁচ দিন আগে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ছানোয়ার জাহানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ইশরাত জাহান ওরফে রিতুর। হাতের মেহেদির রং এখনও শুকায়নি।
বুধবার (১২ জুলাই) সকালে জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের বগালী গ্রামে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায় ছানোয়ার। স্বামীকে হারিয়ে নিস্তব্ধ রিতু। ছানোয়ার ও রিতুর পরিবারে চলছে এখন শোকের মাতম।
ছানোয়ার জাহান (২৮) শেরপুর সদর উপজেলার চরজঙ্গলদী গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে। ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তবে অসুস্থতার কারণে ২০১৯ সালে অবসর নেন। এরপর গ্রামেই থাকতেন। সদর উপজেলার সাপমারী দ্য নিউ অনুপম একাডেমিতে শিক্ষকতা করতেন।
গত শুক্রবার (৭ জুলাই) ছানোয়ার বিয়ে করেন জামালপুরের তুলশীরচর ইউনিয়নের হনুমানেরচর গ্রামের কৃষক এমদাদুল হকের মেয়ে ইশরাত জাহানকে (১৯)।
চরজঙ্গলদী গ্রামের মোল্লাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছানোয়ারের বাড়িতে এলাকাবাসী ও স্বজনদের ভিড়। স্বামীর এমন অকালমৃত্যুর শোকে প্রায় নির্বাক হয়ে গেছেন নববধূ রিতু। ঘরের একটি খাটে দুই পাশে তার শোকাহত বাবা এমদাদুল হক ও মা চায়না বেগম বসে আছেন। ছানোয়ারের বাবা জাহাঙ্গীর আলম, মা নুরুন্নাহারসহ স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
রিতু বলেন, গত বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে কিছু না বলেই বের হয়েছিলেন ছানোয়ার। ব্যবহৃত মোবাইলটিও ঘরেই রেখে যান। সকাল ৯টার দিকে এক ব্যক্তি তার শ্বশুর জাহাঙ্গীরকে ছানোয়ারের মৃত্যুর সংবাদটি জানান। আর কোনো কথা বলতে পারছিলেন না ইশরাত।
ছানোয়ারের মা নুরুন্নাহার বারবার উচ্চ স্বরে আহাজারি করছিলেন, আল্লাহ, এডা কি অইলো। আমার পুলার কপালে কি এইডাই লেহা (লেখা) আছিলো। আমার পোলারে জীবিত ফিরাইয়া দাও, আল্লাহ।
এদিকে পুত্রশোকে বাবা জাহাঙ্গীর আলম নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জামালপুরে চাকরির একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল ছানোয়ার। বাড়িতে ও ঠিকই ফিরল। তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। বাবা হয়ে এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করব। দুনিয়াতে এর চেয়ে বড় কষ্ট কি আরও কিছু আছে।
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ছানোয়ার সেনাবাহিনী থেকে নিয়মিত অবসর ভাতা পেতেন। ভাতা বইয়ে তাকে (জাহাঙ্গীর) নমিনি করা আছে। এখন সংসার চালাতে টাকার প্রয়োজন হবে। তাই ছানোয়ারের অবসর ভাতাটি যেন অব্যাহত রাখা হয়, সে জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান তিনি।
এদিকে নববুধূ রিতুর মা চায়না বেগম বলেন, তার মেয়ে অকালে বিধবা হয়েছেন। এখন ত মেয়ের সব স্বপ্নই শেষ। মেয়ের শ্বশুর জীবিত আছেন। এখন তিনিই (শ্বশুর) তার মেয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর তিনি যুক্তিক যে সিদ্ধান্ত নিবেন, আমরা সেটাই মেনে নিব।
বুধবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে জানাজা শেষে চরজঙ্গলদী মোল্লাবাড়ি গণকবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
স্বজনরা জানান, পেশায় ঠিকাদার জাহাঙ্গীর আলমের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছানোয়ার ছিলেন বড়। মেজ ছেলে শিপন মোল্লা মালয়েশিয়াপ্রবাসী আর ছোট ছেলে রিপন মোল্লা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। একমাত্র মেয়ে বৃষ্টি আক্তার স্থানীয় একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছেন।
জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মো. আবদুল হান্নান মোল্লা বলেন, ছানোয়ার খুব ভালো ও সৎ ছেলে ছিলেন। তার ব্যবহার খুব ভালো ছিল। এলাকায় সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। এই অকালমৃত্যুতে আমরা শোকাহত।