গত বছরের ১৪ জুন রাতে জামালপুরের বকশীগঞ্জে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে পাটহাটি মোড়ে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন বাংলা নিউজের সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম। ১৫ জুন দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাহসী এই সাংবাদিক। ১৬ জুন দাফনের পর ১৭ জুন নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করেন হত্যা মামলা । সবশেষ ১৭ জন গ্রেপ্তার হলেও এখন কারাগারে রয়েছেন প্রধান আসামি মাহমুদুল আলম বাবুসহ ৭ জন। বাকী আসামীরা জামিনে থাকলেও পলাতক রয়েছেন বাবুর ছেলে রিফাতসহ বেশ কয়েকজন।
আজ সেই সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলার এক বছর। ৩৬৫ দিনেও স্বজন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি নাদিমের পরিবার। ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতি এখনো কাঁদাচ্ছে বৃদ্ধা মা আলেয়া বেগমকে।
নিহত সাংবাদিক নাদিমের মা আলেয়া বেগম বলেন- ‘প্রতি শুক্রবার আসলে মনে হয় আমার বাবা আসতেছে। মনে হয়, কিন্তু আমার বাবা আসে না। যদি খালি বলতাম আমি এমন, বাবা আমার রাতের দুইটার সময় আসছে। ঔষধপত্র নিয়ে রাতের দুইটার সময় আসছে। ব্যাকওয়ার্ড রাস্তা, ডাক্তার আসে নাই। আমার বাবা রাতের দুইটার সময় আসছে। পুরো একবছর হয়ে গেলো। কষ্টেই আছি। মনের দিক দিয়ে কষ্ট। সব দিক দিয়েই কষ্টে আছি।’
সাংবাদিক নাদিমের পরিবারের অভিযোগ- হামলার ঘটনা সিসিটিভি ক্যামেরাতে স্পষ্ট থাকলেও তদন্ত কাজ চলছে ধীরগতিতে। আর এই সুযোগে জামিনে এসে নাদিমের পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে আসামীরা। এক বছর পার হতে চললেও মামলার দ্বিতীয় আসামি চেয়ারম্যান পুত্র রিফাত এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় সঠিক বিচার প্রাপ্তি নিয়ে হতাশায় তারা।
নিহত সাংবাদিক নাদিমের মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত বলেন- ‘অনেক আসামি জামিনে আসার পরে নাম কাটানোর জন্য, মামলা উঠানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দেয়। আমরা স্বাভাবিক চলাফেরা বা জীবন যাপন করতে পারছি না। সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। আগে অনেক লোকজন খোঁজ খবর নিতো। বর্তমানে কেউ খোঁজ খবর নেয় না বললেই চলে। মামলার অগ্রগতি নেই বললেই চলে। মামলার কোনো তদন্ত হয় নাই। ভালো করে কোনো তদন্ত হয় নাই। কোনো আসামি ধরা হয় নাই। এখন পর্যন্ত এক বছর হয়ে গেলো। কোনো চার্জশিট দেয়া হয়নি। আমরা আশাহত হয়ে গেছি যে আমরা কি বাবা হত্যার সুষ্ঠু বিচার পাবো?’
নিহত সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী ও মামলার বাদী মনিরা বেগম বলেন- ‘আমরা স্বামী হত্যার এক বছর হয়ে গেলো। আজ পর্যন্ত বাবুর ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বা বাবুর ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা সেই বিষয়ে আমরা কিচ্ছু জানতে পারিনি। আদৌ আমি মামলার বিচার পাবো কিনা? সঠিক বিচার পাবো কিনা? সেই ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। সকল আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি চায় এবং মামলাটির যাতে দ্রুত চার্জশিট হয়। মামলাটি যাতে দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালে যায়। সেই আশা করি।)
নিহত সাংবাদিক নাদিমের বাবা আব্দুল করিম বলেন-‘রিফাতরে আজ পর্যন্ত ধরতে পারে নাই। সে ডিআইজি পান্নার ছত্রছায়ায় তার বাসাতে আছে। বহুত প্রমাণ আছে যে তার বাসাতেই আছে। তার ছত্রছায়ায় আছে। এই মামলায় সম্পূর্ণ থাবা মারছে পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা পান্না। যার জন্য এই রিফাতরে কোনো পুলিশ,ডিবি, সিআইডি কেউ ধরে না। ইচ্ছাকৃতভাবে ধরে না। না হলে, বাংলাদেশেই আছে এই লোকটা। রিফাততো বাংলাদেশেই আছে।’
মামলার আইনজীবী বলছেন- তদন্ত কাজ শেষ না হওয়ায় মামলাটি রয়েছে এক বছর আগের রূপেই। তাই দ্রæত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে মামলাটি বিচারিক কাজে অগ্রসর করার দাবি স্থানীয়দের।
নাদিম হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. ইউসূফ আলী বলেন- ‘তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হলে মামলাটি যে জায়গায় এক বছর আগে ছিল। এখনও একই জায়গায় আছে। অর্থাৎ মামলাটি বিচারিক দিকে অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যতক্ষণ পুলিশ চার্জশিট না দিবে। সেই নাদিম হত্যা মামলায় পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তা, ধীরগতি এই বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং ন্যায় বিচারকে বিঘ্নিত করছে।’
জামালপুর অনলাইন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন-‘আমরা আইনের প্রতি সম্মান রেখে এতোদিন ধৈর্য ধরেছি। আমাদের ধৈর্যের বাধ ভাঙার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অনুরোধ করবো যে- আপনারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিন। এই হত্যাকাণ্ড ও এর পরিকল্পনার সাথে যারা ওতপ্রোতভাবে যারা জড়িত, আমরা তাদের শাস্তি চাই।’
নাদিম হত্যা মামলার বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্বাগতা ভট্টাচার্য মোবাইল ফোনে বলেন-‘সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলায় আমাদের তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।ে এখন অনুমতি পেলেই আমরা প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দিবো।’