স্বামীর ভয়াবহ নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছে রাশেদা বেগম। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছেন বাপের বাড়ি। তার কাছ থেকে আলাদা করা হয়েছে সন্তানদের। ক্র্যাচ দিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষত-বিক্ষত পঙ্গুত্ব জীবন। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন করে জীবন সাজাতে চান তিনি। জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে চান তিনি। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার তাতিহাটি ইউনিয়নের উত্তর ষাইটকাকড়া গ্রামের মৃত সনু শেখের মেয়ে রাশেদা। সম্প্রতি তার জীবনের ফেলে আসা কিছু ঘটনা তুলে ধরেন এ প্রতিনিধির কাছে।
রাশেদা বেগম বলেন, প্রায় ২০বছর আগে চোখে স্বপ্ন আর মনে আশা নিয়ে একই উপজেলার রহমতপুর গ্রামের বাবুল মিয়ার সঙ্গে ঘর বাঁধেন তিনি। কয়েক বছরের ব্যবধানেই তাঁদের ঘরে আসে দুই ছেলে আর এক মেয়ে। কিন্তু যে স্বপ্ন আর আশা নিয়ে রাশেদা ঘর বেঁধেছিলেন- বেশি দেরি হয়নি তা ধুলিস্যাৎ হতে। স্বামীর অলসতা, কর্মবিমুখতা আর জুয়া খেলায় আসক্তির কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই সংসারে আর্থিক দৈন্যতা দেখা দেয়। সে দৈন্যতা ঘুচাতে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিটুকুও বিক্রি করতে শুরু করেন স্বামী। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরনারীর প্রতি আসক্তি।
হঠাৎ একদিন স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে ফেলে তার স্বামী চলে যান ঢাকায়। তার অনুপস্থিতিতে ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য এখন তিনি কী করেন! কোনও উপায়ান্তর না পেয়ে মাটি কাটার কাজ, অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে স্বামীর ভিটা আগলে রাখেন। এত কষ্টের পরও তার আশা ছিল স্বামী একদিন তার কাছে ফিরে আসবে। স্বামী বাবুল মিয়া একদিন সত্যি সত্যি ফিরে এলেন, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে আসেন দ্বিতীয় স্ত্রীকে। এরপরও সতীন নিয়ে ঘর করতে আপত্তি করেননি রাশেদা। তাকে মানতে আপত্তি ছিল সতীনের। তারই প্ররোচনায় চরিত্রহীন অপবাদ দিয়ে রাশিদাকে সন্তানসহ বাড়ি ছাড়া করতে শুরু হয় নির্যাতন। নির্যাতন এত নির্মম হয় যে, একদিন স্বামীর মারের চোটে তার এক হাত ও এক পা ভেঙে যায়।
অভুক্ত অবস্থায় সন্তানদের নিয়ে বিনা চিকিৎসায় একদিন-একরাত ঘরেই পড়ে থাকেন। খবর পেয়ে রাশেদার মা তিন সন্তানসহ মেয়েকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করে সুস্থ করে তোলেন। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেও দুটো ক্র্যাচ রাশেদার পথ চলার সঙ্গী।
এরপর স্বামী আর তাঁকে ঘরে নেননি, তিনিও আর স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাননি। এত নির্যাতন অপবাদের পরও স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি কোনওরকম আইনি ব্যবস্থা নেননি। আমি একবার ব্র্যাক অফিসে একটা দরখাস্ত দিছিলাম। পরে বলছে, যে আমারে তালাক দিছে। বিচার চাইয়া কি অবো-আল্লাই হের বিচার করব। এরপরই শুরু হয় সন্তানদের নিয়ে রাশেদার বেঁচে থাকার লড়াই। পুঁজি মাত্র কয়েক হাজার টাকা নিয়ে নেমে পড়েন দুই বেলা পিঠা তৈরি করে বিক্রি করার ব্যবসায়।
সেই সঙ্গে বিড়ি বাঁধার কাজ। এ থেকে যে সামান্য আয় হয়, তাই দিয়ে চলে মা আর তিন সন্তানের অন্নের সংস্থান। কিন্তু পুষ্টির অভাবে বড় ছেলে রাজু (১২) এক সময় পঙ্গু হয়ে পড়ে। মেয়ে রায়সা (১০) স্কুলে পড়ে আর ছোট ছেলে পাঁচ বছরের সাজুকে নিয়ে তার সংসার।
আলাপচারিতায় রাশেদা বেগম জানান, তাঁকে মেরে হাত পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনার কয়েকদিন পরই স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী পালিয়ে যান। হয়তো ভয়ে। স্বামীর ঘরে এখনও তাঁর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে?-এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদা উদাস হয়ে বলেন, নাহ, আর ইচ্ছা নাই।
তাঁতিহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, রাশেদা খুব অসহায় একজন নারী। তাঁর বিষয়টি নিয়ে শালিস-দরবারও করেছি। অনেক কষ্টে-শিষ্টে তার সংসার চলছে। তাঁকে আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি ভিজিডি কার্ড দিয়েছি।
শ্রীবরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজহুরা বলেন, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার জীবন সংগ্রামে আত্মপ্রত্যয়ী নারী রাশেদা বেগম। গতবছর বেগম রোকেয়া দিবসে তাঁকে ‘জয়িতা সম্মাননা’ প্রদান করা হয়েছে। তিনি উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এ সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি নারী সমাজের জন্য অনুকরণীয় একজন আর্দশ। এই নারী এখন সমাজের মডেল।