শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায় ধান চাষের উপযোগী সমতল জমিতে সম্ভাবনাময় ফল মাল্টার চাষ করে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছেন উপজেলার টালকী ইউনিয়নের ফুলপুর এলাকার আলহাজ্ব আব্দুর রহমানের ছেলে মো. অনোয়ার হোসেন। প্রতিদিন মাল্টা বাগান পরিচর্যার মধ্যদিয়ে আনোয়ার হোসেন’র সারা দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। এ বাগানকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
আনোয়ার হোসেন রাজধানী ঢাকায় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এবং বেতন ভাতাও পেতেন ভালো। কিন্তু পরিবারিক প্রয়োজনে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে এসে মাল্টার বাগান করার পরিকল্পনা করেন। শুরুতে লোকসানের ভয়ে বিষয়টিকে পরিবারের কেউই ভালোভাবে না নিলেও, এখন তার সফলতা দেখে সবাই তাকে সহযোগিতা করছেন। ২০১৭ সালে ১০ শতক জমিতে ৫০টি গাছ দিয়ে তিনি মাল্টার বাগান শুরু করেন। ওই বছরই প্রতিটি গাছে ৫-৭ টি করে মাল্টা ধরে। এরপর মাত্র ৩ বছরেই তিনি আজ সফল মাল্টা চাষির পরিচিতি পেয়েছেন। আনোয়ারের বাগানের আশেপাশের বাতাসে যেন টক-মিষ্টির গন্ধ। গাছের পাতার চেয়ে মাল্টা বেশি ধরেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে উকি দিচ্ছে মাল্টা। কম্পোস্ট, কেঁচো বা ভার্মিকম্পোস্ট, খৈল ও গোবরসহ বিভিন্ন জৈবসার ব্যবহারে প্রাকৃতিক বেড়ে উঠা বাগানের ওইসব গাছে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে ছোট বড় হাজারো মাল্টা। ফলের ভারে পুরো বাগানের গাছগুলো যেন নুয়ে পড়েছে। এ দৃশ্য ও আনোয়ারের সফলতা দেখে যেকেউ বিমোহিত হবেন। কৃষি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন তার বাগান দেখতে প্রতিদিনই ভীড় জমাচ্ছেন। গাছে থোকায় থোকায় মাল্টা ধরায় এ অঞ্চলে মাল্টা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও চাষীরা। মাটির গুণাগুণ বিবেচনায় বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলায় চাষ উপযোগী হলেও সমতল অঞ্চলে মাল্টা ও কমলা লেবুর মতো বিদেশি ফলের ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। আজ তা প্রমাণ হতে চলেছে বলে জানান কৃষি অফিসার ও আনোয়ারের মতো অনেক মাল্টা চাষী। অধিক ফলন ও লাভ বেশি হওয়ায় এলাকার অনেকে অন্যান্য আবাদ ছেড়ে মাল্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। শখের বসে বাড়ীর আঙ্গীনায় ২-৪ টি করে মাল্টা গাছ রোপণ করে সুফল পাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বানিজ্যিক ভাবে মাল্টা বাগান করার লক্ষ্যে ধানের আবাদি জমি নির্বাচন করে বাগান করার কাজ শুরু করেছেন।
স্থানীয় ফল ব্যবসায়ীরা জানায়, আনোয়ার হোসেনের বাগানের মাল্টা আকারে বড়, রসালো, খেতে সুস্বাদু ও নিরাপদ হওয়ায় স্থানীয় বাজার গুলোতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে আনোয়ারের যেমন বাজার জাতের কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না, তেমনি স্থানীয় ফল ব্যবসায়ীদের বিক্রি বেড়েছে। তার বাগানের মাল্টা গুলো কাঁচা অবস্থায় গাড় সবুজ এবং পাকলে হালকা হলুদ রং ধারণ করে। প্রতিটি মাল্টার ওজন গড়ে ১৫০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম হয়ে থাকে। তারা আরও বলেন, বিদেশি মাল্টা দেশের বাজার দখল করে রাখলেও, পিছিয়ে নেই আনোয়ারের ক্ষেতে উৎপাদিত এ মাল্টার মতো দেশে উৎপাদিত মাল্টা।
অতিরিক্ত উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রোকসানা নাসরীন বলেন, দেশে বারি মাল্টা-১ (পয়সা মাল্টা), বারি মাল্টা-২, থাইল্যান্ডের বেড়িকাটা মাল্টা ও ভারতীয় প্রলিত মাল্টা জাতের চাষ করা সম্ভব। তবে নকলায় চাষ করা অধিকাংশ মাল্টা বারি-২ জাতের। তিনি মাল্টা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানান, সমতলে ৬০ সেন্টিমিটার বর্গাকার বা আয়তাকার গর্ত করে ৪-৫ মিটার দূরত্বে বৈশাখ মাসে চারা বা কলম কাটা চারা লাগাতে হয়। প্রতি গর্তের মাটির সাথে ১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, সমপরিমাণ এমওপি ও চুন, ৩ থেকে ৫ কেজি ছাই মিশিয়ে ভরাট করে মাদা তৈরীর করে, ১০ থেকে ১৫ দিন পরে চারা বা কলম কাটা চারা লাগাতে হয়। এরপর হালাকা সেচ দিতে হয়। আগাছা দমনসহ বর্ষকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। চারা অবস্থায় মাল্টা গাছের গোড়া থেকে গজানো অতিরিক্ত কুশি বা মাথা এবং মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল মাঝে মাঝে ছেটে রাখতে হয়।
এ ব্যাপারে নকলা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস বলেন, মাল্টা একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। দো-আঁশ মাটি মাল্টা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। নকলার মাটি ও আবহাওয়া মাল্টা চাষের উপযোগী। আনোয়ার হোসেন মাল্টার বাগান করে সুফল পেয়ছেন, লাভবান হয়েছেন। কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের
পরামর্শ ও সহযোগীতা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।