শেরপুর সীমান্ত অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে দুটি ইউনিয়নে ১১টি গ্রামে দেখা দিয়েছে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। বিশুদ্ধ খাবার পানি না পেয়ে ঝর্ণা, পুকুর ও কুয়ার পানি পান করছেন এলাকার মানুষ। প্রতি বছর বোরো মৌসুমে অন্তত ৪ থেকে ৫ মাস পানির অভাবে থাকতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। যদিও সঙ্কট সমাধানের জন্য আশ্বাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝিনাইগাতীর পানবর, গুরুচরণ দুধনই, গজনী গান্ধিগাঁও, বৃষ্ণপুর গ্রাম ও শ্রীবরদীর বালিজুড়ি, খারামোড়া, হালুয়াহাটিসহ দুই উপজেলার মোট ১২টি গ্রামে প্রচুর পাথর থাকায় ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ নলকূপ দিয়ে পানি আসে না। পানি তোলার জন্য একমাত্র বিদ্যুৎচালিত গভীর সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে পানি উত্তোলন করা সম্ভব। যা এক থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। তাই প্রতি প্রতিবছর বোরো মৌসুম এলেই এমন সমস্যা সৃষ্টি হয়। যা ৪ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত কষ্ট করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। আবার ওই এলাকায় যারা সচ্চল মানুষ আছে তারা ব্যক্তি মালিকানায় বিদ্যুৎচালিত গভীর সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছেন। ওইসব বাড়ি থেকে পানি নেওয়ার জন্য আশপাশের লোকজন জগ, বালতি, কলস এবং বোতল নিয়ে ভিড় করেন।
শ্রীবরদীর বালিজুড়ির হালুয়াহাটি এলাকায় সরেজমিনে জানা যায়, টিউবওয়েলগুলোতে পানি নেই। টিউবওয়েল চাপ দিলে পানি আসে না। মাঝে মাঝে দু’এক ফোঁটা পানি বের হচ্ছে। এজন্য খাওয়া, রান্না ও প্রতিদিনের কাজের জন্য পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসছেন মানুষ। সেই পানি দিয়ে থালা-বাসনসহ নানা কাজে ব্যবহার করছেন তারা। শুধু তাই নয়, ঝর্ণা ও কুয়ার পানি খাচ্ছে এখানকার শিশুরা। ফলে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকা পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায় এই বোরো মৌসুমে। তাই বাধ্য হয়েই ময়লাযুক্ত পানি খেতে হয় তাদের। এতে ময়লা পানি খাওয়ার কারণে নানা অসুখ হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের। তাই পানি সঙ্কটের গ্রামগুলোর আশপাশে কয়েকটি সাবমারসিবল পাম্প থাকলে হয়তো পানির সঙ্কট সমাধান হবে।
রাণিশিমুল ইউনিয়নের বাসিন্দা রমজান আলী জানান, ‘আমি ধানক্ষেতে পানি দিতে একটি বিদ্যুৎচালিত সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছি। বোরো মৌসুমে এই এলাকায় কোনো টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। তখন আমার পাম্প থেকেই এ এলাকার মানুষ পানি নিয়ে যায়। মেশিন চালু করলেও সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এতে তাদেরও অনেক কষ্ট হয়, আমারও অসুবিধা হয়।’
হালুয়াহাটি গ্রামের বাসিন্দা রেজুয়ান বলেন, ‘আমগর এইদিকে পানি থাকে না এই বোরো মৌসুমে। এই মৌসুমে পানি নিচে চলে যাইগা। প্রতি বছরই এমন সমস্যা হলেও সরকার এইদিকে নজর দেয় না। আমরা যে পানির জন্য কত কষ্ট করি, কত ময়লা পানি খাইতেছি। আর এইসব ময়লা পানি খাওয়ার কারণে বিশেষ করে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই, যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের এই দিকে সাবমারসিবল পাম্প বসায়।’
ওই এলাকার বাসিন্দা হযরত মিয়া বলেন, ‘ভাই আমরাতো গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই, এতো ট্যাহা নাই যে সাবমারসিবল পাম্প বসামু। কত যে কষ্ট করি পানির জন্য। আমগর বাড়ির একটু দূরে একজন পাম্প বসাইছে, সেখানে থেকে বালতি ভরে ভ্যান গাড়ি দিয়ে পানি আনি।’
ঝিনাইগাতীর বৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা আঃ জলিল মিয়া বলেন, ‘ভাই আপনারা প্রতি বছরই আহেন, কলতো দেন না, খালি ছবি তুলে নিয়ে যান গা। এবার ছবি তুললে আগে কল দেন, তারপর ছবি তুলবেন। হুনি সরকার কত কিছুই দিতাছে কিন্তু আমাগরে খালি কলই দেই না। কয়ডা কল হলে এখানে পানির আর কষ্ট থাকবে না।’
রেহেনা আক্তার বলেন, ‘অনেকদিন থেকে আমরা রান্না ও খাওয়ার জন্য অন্য বাড়ি থেকে পানি টেনে টেনে নিয়ে আসি। খুব কষ্ট হয় পানি আনতে।’
ঝিনাইগাতীর পানবর এলাকার ৪র্থ শ্রেণী পড়ুয়া লামিয়া বলেন, ‘আমগর কলে পানি আহে না, আমি পুকুরে গোসল করি। আর আম্মা পানি আগুন দিয়ে ফুঁটায়া দেয়, ওই পানি খাই। অনেক সময় দেহা যা আম্মা ব্যস্ত থাহে ওই টাইমে ঘরে যে পানি থাহে অইডাই খাই।’
শ্রীবরদীর খারামোড়া গ্রামের আরেক শিশু জান্নাত আরা বলেন, ‘পানি বারাই না কল থনে, আম্মা মেলা দূর থনে পানি নিয়ে আহে। আম্মার মেলা কষ্ট হয়, তাই আঙগর উনু এডা কল দেন।’
দরিকালিনগর, সারিকালিনগর, প্রতাবনগরের লোকজন বলেন, গরিবের সব বিষয়েই কষ্ট! পানির অভাবে পুকুরের পচা পানিতে গোসল করতে বাধ্য হই। এই ভোগান্তি অবসানে সাবমারসিবল পাম্প দরকার। কিন্তু এত টাকা পামু কই?
কালিনগরের শামসুল হক, জামাল উদ্দিন সরকার, প্রতাব নগরের শতবর্ষী ডা. আব্দুল বারী ও আলহাজ রেজায়ুর রহমান মাস্টার বলেন শীতের মৌসুমে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট দেখা দেয়। এতে খুব কষ্ট করে পানি যোগাতে হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন বলেন, পাহাড়ি নদীগুলো নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে, নদী যেন দখল না হয় সেজন্য তদারকি করতে হবে। আর বর্ষা মৌসুমে বাড়ির আঙিনায় বা আশপাশের জলাধারগুলোতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
শ্রীবরদী উপজেলা চেয়ারম্যান এ ডি এম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রীবরদীর সীমান্তে কয়েকটি গ্রামের পানির সঙ্কট আছে। গত বছর কয়েকটি সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে, এই মৌসুমেও পাম্প বসানো হবে সেজন্য কাজ করা হচ্ছে। শিগগিরই পানির সঙ্কট থেকে সমাধান হবে আশা করি।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম বলেন, ‘ঝিনাইগাতীর বেশ কয়েকটি গ্রামে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি ওঠে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু কিছু জায়গায় সাবমারসিবল পাম্প বসাচ্ছি। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করছি খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।’
শেরপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউল হক বলেন, ‘সীমান্তে পাহাড়ি এলাকায় পানি সঙ্কট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে সাধারণ মানুষ বিশুদ্ধ পানি খেতে পারে এজন্য ইতোমধ্যে কয়েকটা গভীর পাম্প বসানো হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় বেশি পানির সমস্যা, সেসব এলাকায় বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে গভীর নলকূপ ও সাবমারসিবল পাম্প বসানো হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আরও বরাদ্দ চেয়েছি, বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সব গ্রামেই পাম্প বসানো হবে। এতে ওইসব এলাকার পানির সঙ্কট দূর হবে।’