নাঈম ইসলাম : “আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে ধুত্তুর ধুত্তুর ধুত্তুর ধু সানাই বাজিয়ে। যাবো তোমায় শ্বশুর বাড়ি নিয়ে…” সময়ের পালাবদলে এই গান মনে বাজলেও মেঠো পথের গরুর গাড়ি আর চোখে পড়ে না এখন। শুধু তাই নয় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গাড়িয়াল ভাইকেও আর দেখা যায় না বাস্তবে। শোনা যায় না- “ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে…”
আধুনিকায়নের কারণে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে বয়ে চলা গরুর গাড়ি শেরপুরে এখন আর চোখে পড়ে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহি গরুগাড়ী আজ হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষকের উৎপাদিত ফসল বহন, বিবাহ অনুষ্ঠান, মেলা ও ভ্রমণের একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ী। এক সময় কৃষদের ঘরে ঘরে গরুগাড়ী ও গরুর হাল ছিল।
গরুর গাড়িতে ছাওনি সাজিয়ে শশুরবাড়ী ও বাবার বাড়ী আসা যাওয়া করতেন নববধু। মেলা বারুনিতে আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাবার সঙ্গে ছেলে মেয়েরা গরুরগাড়িতে চড়ে বেড়াতে আসতেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে ৪০/৫০টি সাজানো গরুর গাড়ীর বহর নিয়ে বরপক্ষ কনের বাড়ির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। এক সময় জনপদে এই বাহনের সরগরম অস্তিত্ব ছিল, সর্বত্র কদরও ছিল গরুর গাড়ির। মাত্র দুই যুগ আগেও পণ্য পরিবহন ছাড়াও বিবাহের বর-কনে বহনে বিকল্প কোন বাহন কল্পনাই করা যেত না। যেসব পরিবারে গরুর গাড়ি ছিল, তাদের কদরের সীমা ছিল না।
কৃষকরা প্রতিদিন ফজরের আজানের আগে গরুর গাড়িতে কখনো জৈবসার (গোবর সার) কখনো গরুর খাবার ও লাঙ্গল-মই-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেত। সুপ্রাচীনকাল থেকে দেশের গ্রামীণ জনপদে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে গরুর গাড়ির বহুল প্রচলন পরিলক্ষিত হতো। পায়ে চলার পথে মানুষ পশুর শ্রমে চলিত গরুর গাড়ি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ও বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করত প্রাচীনকাল থেকেই। এখন আর তাকিয়ে থাকলেও গরুর গাড়ি চোখে পড়ে না।
আধুনিকতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে গাড়িয়াল পেশাও। যা একদা ছিল বংশ পরম্পরায়। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারকবাহক অনেক বাহনেরই আমূল পরিবর্তন, আধুনিকায়ন সাধিত হয়েছে।
মুন্সিরচরের বাসিন্দা ইকরামুল হক বলেন, আমাদের চরে এখনো গরু ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যাবহার আছে। তবে তুলনামূলক কম। ট্রলি গাড়ির পরিবহনে সুবিধার কারনে গরুর গাড়ির ব্যাবহার কমে যাচ্ছে আমাদের চরাঞ্চলে।
চরশেরপুরের গাড়িয়াল (গরুগাড়ি চালক) গোলাপ মিয়া বলেন, রুজি রোজগাড় আর আগের মত নেই। তবে ক্ষেত থেকে ধান, গম, পাট গৃহস্তের বাড়িতে পৌছে দেওয়ার জন্য আমায় এখনো ডাকে।
কামারের চর বাজারের মারেফত বেপারী বলেন, এক সময় এখান থেকে শেরপুর শহরে আমরা আলু, ধান, গম, পেয়াজ সহ নানান ধরনের পণ্য গরুর গাড়ি করে নিয়ে যেতাম। কিন্ত এখন লেগুনা ট্রাক ক্ষেত থেকে পণ্য নিয়ে আসে এবং দ্রুত সময়ে হাটবাজারে পৌছে দেয়। তাই গরুর গাড়ির প্রয়োজন হয়না।
ঐতিহ্যবাহি গ্রামবাংলার গরুর গাড়ি আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য গরুর গাড়ির ভাস্কর সহ ভিডিও চিত্র বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জাদুঘর ও পিকনিক মিউজিয়াম গুলোতে সংরক্ষন করা উচিৎ। গরুর গাড়ি নিয়ে রচিত হয়েছে গান গল্প কবিতা ও সিনেমা। প্রতি বছরে ১লা বৈশাখে মঙ্গলযাত্রায় প্রধান দৃশ্য হচ্ছে সেই গরুর গাড়ি। বর্তমান কৃষকদের বাড়ীতে গরুগাড়ী ও গরুরহাল এর পরিবর্তে পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর জায়গা করে নিয়েছে।