সুজন সেন : সদিচ্ছা, মেধা আর শ্রম দিয়ে পাহাড়ি অনাবাদি পতিত জমিতে ওষুধি ও ফলদ গাছের মিশ্র বাগান তৈরি করে সফলতা পেয়েছেন এক আদিবাসী তরুণ। তার নাম প্রাঞ্জল এম সাংমা।
শেরপুরের শ্রীবরদীর প্রত্যন্ত অঞ্চল হারিয়াকোনায় গড়ে তোলা হয়েছে ওই বাগান। এখন আশেপাশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা বিলুপ্ত প্রজাতির ওষুধি গাছ সংগ্রহ করছেন তার কাছ থেকে। আর বিষমুক্ত ফল পেতে অনেকেই ভিড় করছেন তার ফল বাগানে। আর ওই বাগানে কাজ করে বেশ কয়েকজন আদিবাসী ঘুচিয়েছেন বেকারত্ব। এই আদিবাসী তরুণের সফলতা দেখে আশপাশের আরো অনেক তরুণ উদ্যোগী হয়েছেন এমন মিশ্র জাতের বাগান করতে।
প্রাঞ্জল এম সাংমা জানান, ২০১৫ সালে চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তার নিজের অনাবাদি ও পতিত পড়ে থাকা পাহাড়ি নয় বিঘা জমির আগাছা পরিষ্কার করে ২০০ আম্রপলী, ২০০ চায়না হাইব্রীড লিচু, ৬০০ সুপারি, ৩০০ লটকন এবং দেশি জাতের আনারস ও বারোমাসি আম গাছের চারা রোপন করেন। এছাড়াও ওইসব গাছের ফাঁকে ফাঁকে ২০ হাজার শতমূল এবং ২০ হাজার এলোভ্যারা বা ঘৃতকুমারির চারা রোপন করেন। এর পাশাপাশি হলুদ-আদাসহ কিছু সবজির আবাদও করেন। আট মাসের মাথায় শতমূল এবং ঘৃতকুমারির চারাগুলো পরিপক্ক হয়ে উঠে। বুঝতে পারেন স্বপ্ন এখন বাস্তবতায় রুপ নিচ্ছে। বাগানের খবর ছড়িয়ে পড়ে নিজের জেলাসহ আশপাশের জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা পর্যন্ত। সেখানকার ওষুধি গাছের ব্যবসায়ীরা তার সাথে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করেছেন চারা।
চলতি আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন প্রায় ২৬ হাজার ঘৃতকুমারি গাছের পাতা। এছাড়া শতমূলের গাছ বিক্রি হয়েছে আরও লক্ষাধিক টাকার। এ বছর বাগানের আম বিক্রি হয়েছে প্রায় লাখ টাকার। তিনি জানান, ঘৃতকুমারির পুরাতন গাছ থেকে উৎপাদিত আরো প্রায় এক লাখ চারা পাঁচ টাকা দরে প্রায় পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। পাশাপাশি আদা-হলুদসহ অন্যান্য সবজি, আনারস ও সুপারি বিক্রি করা যাবে মওসুম মতো। বাগান পরিচর্যার জন্য স্থানীয় ১০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। এ মিশ্র বাগানে কোনো রকমের কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে কেবল জৈব সার, পানি আর সঠিক পরিচর্যায় প্রতিটি গাছ পরিপুষ্ট করা হয়েছে।
জামালপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী সোহেল বলেন, এই বাগানের ঘৃতকুমারি ও শতমূল উন্নত জাতের হওয়ায় এখান থেকেই তা কিনে নিচ্ছি। সীমান্তঞ্চল হওয়ায় এ পর্যন্ত আসতে আমার একটু কষ্ট হলেও ভালো জিনিসটাই পাচ্ছি।
শেরপুর শহরের চকপাঠক থেকে আসা বকুল বলেন, রাসায়নিক সার বিহীন বারোমাসি আমসহ আম্রপলী পাওয়া যায় এখানে। এমন খবর পেয়ে নিজের ছেলে মেয়েদের জন্য এখানে আম কিনতে এসেছি।
বাগানের শ্রমিক দরাজ ব্রং, ধনেশ কুবি, পাভেল সাংমা বলেন, পাহাড়ে কাজের খুব অভাব। এক সময় লাকড়ি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চলতো। এখন এই বাগান হওয়ায় নিয়মিত কাজ করছি। প্রতিদিন আমরা ৪০০ টাকা মজুরি পাচ্ছি।
স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রবেন হাগিতক জানান, পাহাড়ি ঢালুতে পতিত পড়ে থাকা হাজার হাজার একর জমিতে স্বল্পমেয়াদী ওষুধি, ফলদ ও সবজির মিশ্র বাগান করার এখানে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রাঞ্জল সাংমার মিশ্র বাগান দেখে এলাকার অনেক বেকার এবং স্থানীয় আদিবাসী কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের মিশ্র বাগান করতে আগ্রহী হয়েছেন।
মিশ্র প্রজাতির বাগান করতে আগ্রহী ব্রতিন মারাক, লপকোচ মারাক ও লোচন মারাক বলেন, গহীন পাহাড়ে এমন বাগান গড়ে তোলা সম্ভব প্রাঞ্জল এম সাংমা তা প্রমাণ করেছেন। তাকে অনুসরণ করে আমরাও ছোট পরিসরে মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। বাগান তৈরিতে বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে পরামর্শও নিচ্ছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হাসান শেরপুর টাইমসকে বলেন, প্রাঞ্জল এম সাংমা অত্যন্ত সফলতার সাথে পাহাড়ি অনাবাদি পতিত জমিতে ওষুধি ও ফলদ গাছের মিশ্র বাগান তৈরি করেছেন। তার দেখাদেখি সেখানকার অনেকেই এখন এ ধরনের বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। উপজেলা কৃষি অফিস তা বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।