শেরপুরের দুই উপজেলার পাঁচটি বিদ্যালয় মাঠে দীর্ঘদিন যাবত বসছে গবাদিপশুর হাট। প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে গরু, মহিষ ও ছাগল বিক্রির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যালয় মাঠগুলো। এ কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিদ্যালয় ছুটি দেয়ায় যেমন পাঠদানে বিঘœতার সৃষ্টি হচ্ছে, আর পশুর বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বিদ্যালয়ের পরিবেশ। ফলে ওইসব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ১০ হাজার শিক্ষার্থী পড়েছে চরম দুর্ভোগে।
তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এসব হাটের নিয়ন্ত্রণ কর্তা খোদ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি। ওইসব কমিটির সদস্যরা নিজেদের সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা বলেও পরিচয় দেন। এহেন পরিস্থিতিতে পশুরহাট সরিয়ে নিতে স্বস্ব বিদ্যালয় প্রধানরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে ধারাবাহিকভাবে জানালেও সমাধান পাননি। অন্যদিকে বিদ্যালয় মাঠে পশু বিক্রি না করতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, শেরপুরের নকলা ও ঝিনাইগাতী উপজেলার পাঁচটি বিদ্যালয় মাঠে দীর্ঘদিন যাবত বসছে গরু, মহিষ ও ছাগলের হাট। এরমধ্যে নকলার প্রত্যন্ত এলাকা পাঠাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের সাড়ে তিন বিঘা জমি জুড়ে গত ৪০ বছর যাবত বসছে গরু, ছাগল ও মহিষের বিশাল হাট। এ হাটে প্রতি সপ্তাহের রবিবার আশপাশের গ্রামের মানুষ এবং দূর দূরান্তের লোকজন ভটভটি ভরে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন গবাদিপশু। একই দিনে পাঠাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠেও বসে একই রকম হাট। এ হাটগুলো ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এছাড়া নকলা শহরের প্রাণকেন্দ্রের নকলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বিস্তৃর্ণ মাঠ ইজারা দিয়ে গরু ছাগলের হাট বসাচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ । এ হাট বসছে প্রায় ৩০ বছর যাবত। প্রতি বৃহস্পতিবার বিপুল পরিমাণ পশু এ হাটে আনা হয়। অন্যদিকে শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়কের কালিবাড়ি এলাকার চেঙ্গুঁরিয়া আনছার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই বিঘা আয়তনের মাঠে বসে পশুর হাট।
২০০৯ সালে জেলা প্রশাসন জমিটি ধানের বাজারের পরিবর্তে গরুর হাট হিসেবে ইজারা দেয়। প্রতি বুধবার এ হাট বসে। এছাড়া একই দিনে কোন রকম অনুমতি ছাড়াই চেঙ্গুঁরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বসে পশুর হাট। হাটের দিন বিদ্যালয়গুলোর প্রধান ফটক থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের মূল ভবনের বারান্দা পর্যন্ত গবাদিপশু নিয়ে বসে বিক্রেতারা। অনেকেই করেন ধূমপান। বিক্রির জন্য পুরো মাঠ জুড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বিপুল সংখ্যক পশু। এছাড়া পশুর মল-মূত্র ও বর্জ্য বিদ্যালয় মাঠের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় ছড়ায় দুর্গন্ধ।
ওইসব বাজারে ভ্রাম্যমাণ দোকানিরাও বিভিন্ন ধরণের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের চেঁচামেচি আর উচ্চঃস্বরে গরুর হাকডাকে অস্বস্থিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয় বিদ্যালয় চত্ত্বর জুড়ে। তাই বাধ্য হয়েই আগেভাগেই কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করে। এসব কারণে বিভিন্নভাবে দূর্ভোগের শিকার হচ্ছে ওইসব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা।
আমাদের প্রাণকেন্দ্রই হলো বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। এ মাঠে সবুজ ঘাষ না থাকায় আমরা খেলাধুলা করতে পারিনা। প্রতি সপ্তাহে গরুর হাট বসার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া হাট বসার কারণে অনেক আগেই আমাদের ছুটি দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে পড়ালেখার প্রতিযোগীতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। শুধু তাই না হাটের দিন গরু, মহিষ ও ছাগলের মল, মূত্র এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় পরদিন ক্লাস করতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে। ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ধোয়া-মোছার কাজ করতে হয়। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় এই দুটি ক্লাসের সময় আমাদের নষ্ট হচ্ছে। এমন বক্তব্য শিক্ষার্থী সুমন, তারেক, আবু মিয়া, নয়ন, কায়সার, তনয়, তৌফিকসহ আরও ২০জনের।
ঝিনাইগাতীর চেঙ্গুঁরিয়া আনছার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজগর আলী বলেন, বিদ্যালয় মাঠে গরুর হাট না বসাতে ইজারাদার এবং ম্যানেজিং কমিটিকে বারবার অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হলেও কোন লাভ হয়নি। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয় মাঠ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখার ব্যবস্থা করি। সম্প্রতি রাতের আধারে কে বা করা সেইসব কাঁটাতার উঠিয়ে নিয়ে যায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাটে গরু ছাগলের বিপুল পরিমান ক্রেতা বিক্রেতার সমাগম ঘটে, হাট বসে দুপুর থেকে রাত অবধি। মানুষজন বিদ্যালয়ের বারান্দা এবং বিদ্যালয়ের পেছনে পায়খানা, প্রশ্রাব করে। পরদিন বিদ্যালয় খোলা হলে প্রশ্রাব পায়খানার দুর্গন্ধে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
নকলার পাঠাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ বি এম বেনজির আহমেদ বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠ গোহাটা হিসাবে ব্যবহার করার ফলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ প্রতিনিয়ত বিঘ্ন হচ্ছে। গরুর হাট বসার পরদিন বিদ্যালয় মাঠ থাকে অপরিস্কার। ফলে শিক্ষার্থীদের চলাচল এবং আমাদের চলাচলে খুব সমস্যা হয়। হাটটি সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রতি বছরই লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কাছে দিয়েছি। হাটের সাথে এলাকার লোকজন এবং বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অনেক সদস্যই এর সাথে জড়িত, তাই বেশী কিছু বলতে পারিনা। আমরা চেষ্টা করেও ব্যর্থ । একমাত্র প্রশাসনই হাট সরানোর বিষয়ে সাহায্য করতে পারে।
গরুর হাটের কারণে দিন দিন শিক্ষার্থীদের বার্ষিক ফলাফল খারাপ হচ্ছে এমন অভিযোগ করে অভিভাবক মমিনুল খান বলেন, এবার পাঠাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে ১৬৭ জন শিক্ষার্থী টেস্ট পরীক্ষা দিলেও পাস করেছে মাত্র সাতজন।
অভিভাবক রাসেল বলেন, গরুর হাট বসার কারণে ওইসব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ১০ হাজার শিক্ষার্থী চরম দূর্ভোগ পোহাচ্ছে। বৃষ্টির সময় বিদ্যালয় মাঠ থাকে কর্দমাক্ত, ছেলে মেয়েরা তখন স্বাভাবিকভাবে মাঠে চলাফেরা করতে পারে না, তাই তারা বিদ্যালয়েও যায়না। আর খেলাধুলা করার কথাতো চিন্তাই করা যায়না।
আরেক অভিভাবক জয়নাল অবেদীন বলেন, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এসব গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ কর্তা খোদ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি। ওইসব কমিটির সদস্যরা নিজেদের সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা বলেও পরিচয় দেন। তাই এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করার সাহস আমরা পাইনা।
গরুর হাট বসলেও কোন সমস্যা হচ্ছেনা বলে দাবি করেন পাঠাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আওয়াল ফকির ।
অন্যদিকে বিদ্যালয় মাঠে পশু বিক্রি না করতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে সরকার বদ্ধ পরিকর। তারপরও দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু বিদ্যালয়ের মাঠ গবাদিপশু বিক্রির জন্য অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওইসব বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং এবং বাজার কমিটি রয়েছে। এই দুই কমিটির সমন্বয় থাকলে বাজারের কোন পণ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যত্রতত্র বিক্রি হতে পারে না। এছাড়া জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে যাদেরকে লীজ প্রদান করা হয়েছে তাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরুর হাট না বসাতে চিঠি দেয়া হবে বলে জানান তিনি।