শেরপুরের উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। যেখানে পানি দ্রুত কমছে ওইসব এলাকার কৃষকদের নানা রকমের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সামনে আসছে। এরমধ্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত গবাদি পশু ও উন্নত জাতের ঘাসের বাগানের ক্ষতি হয়েছে ১১লাখ ২৮হাজার টাকার। তবে এ ক্ষতির চিত্র প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল হাই। অন্যদিকে, ক্ষতির পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশী হবে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় জেলার সদর উপজেলা, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ীর ১৪টি ইউপির প্রায় শতাধিক গ্রামে পানি প্রবেশ করে। এতে মানুষের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়ে পশু পাখিও। তাই বন্যা কবলিত এলাকার কৃষকদের গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগী, মহিষ ও কবুতর উঁচুস্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করা যায়নি ওইসব পশু পাখিদের। অবকাঠামোসহ বন্যায় ভেসে গেছে হাঁস মুরগীর খামার। আর গরু- ছাগলের খাবার হিসাবে ব্যবহৃত ১০৫ টন উন্নত জাতের ঘাস পানিতে পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাব অনুয়ায়ী হাঁস ভেসে গেছে এক হাজার ৫৫০টি ও মুরগ-মুরগী ৪৪২টি। তবে প্রতিদিন জেলার পাঁচ উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
জেলায় মোট গরু আছে ৩লাখ ৯৮ হাজার ৮৯০টি, মহিষ ছয় হাজার ২৪৫টি, ছাগল এক লাখ ৮২ হাজার ৮৯০টি, ভেড়া ৮ হাজার ৯৬৮টি, শংকর জাতের গাভী আছে ৪০ হাজার ৯২০টি, ১০ লিটারের অধিক দুধ দেয় এমন গাভী আছে দুই হাজার ৪১০টি, গেল কুরবানীর ঈদে গরু মোটাতাজাকরণ করা হয়েছিল ৪৫হাজার ৪৪১টি, মুরগ-মুরগী ১৯ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮টি, হাঁস ৫লাখ ৬৮হাজার ৭৭৮টি, কবুতর ৩৩ হাজার ৭৬৬টি। আর টার্কিসহ অন্যান্য পশু-পাখি রয়েছে ৬০ হাজার ৭৫৬টি।
এছাড়া রেজিস্টার দুগ্ধ খামার রয়েছে ২৯৫টি, গরু মোটাতাজাকরণ খামার ৫৯টি, মহিষের খামার ৭টি, ছাগলের খামার ১৮০টি, ভেড়া ১২৫টি, ব্রয়লার খামার রয়েছে ৪৫১টি, লেয়ার খামার ৩৮টি, হাঁসের খামার ১৮২টি, এছাড়া অন্যান্য আরো ৪৯টি খামার রয়েছে।
সদর উপজেলার নতুন ভাগলগড় গ্রামের কৃষক শাহাদত হোসেন বলেন, বন্যার পানি কিছুটা কমলেও গৃহপালিত গরু, ছাগল ও ভেড়া নিয়ে তারা বিপদে রয়েছেন। কারণ এসব পশুদের খাবার সংস্থান করতে পারছেন না তিনি। যখন বন্যার পানিতে পুরো গ্রাম ডুবে যায় তখন তার তিনটি ছাগলের বাচ্চা ও একটি বাছুর মারা যায়। আর এখন গোবাদি পশুর শরীরে নানা রোগ ব্যাধি দেখা দিচ্ছে।
আরেক কৃষক আরজ আলী বলেন, বন্যায় ১৪টি গরু ছাগল ও ভেড়ার একটি পাল নিয়ে পার্শ^বর্তী জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বন্যায় তার একটি গরু ও দুইটি ভেড়া মারা গেছে। এই গরু-বাছুরই তার সম্পদ। এখন বাকি পশুগুলোকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘাস, পাতা সংগ্রহ করে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত কয়েকদিন যাবত তার তিনটি গরু অনবরত পাতলা পায়খানা করে যাচ্ছে। ওই গরুগুলো এখন বাঁচবে কিনা এ নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোতালেব বলেন, বন্যায় কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক কৃষককের বিপুল পরিমাণ জমির রোপা-আমন বীজতলা এবং সবজি ক্ষেত পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে মরার উপর খাড়ার ঘা গোবাদি পশু নিয়ে। গেল কোরবানীর ঈদে অনেক কৃষক পানির দরে তাদের পোষা গরু ছাগল বিক্রি করে দিয়েছে। আর এখন পশুর খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন পশু পালনকারিরা। অনেক পশু নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
তিনি দাবি করেন, জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ এবারের বন্যায় গোবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশী ক্ষতির শিকার হয়েছে পশু পালনকারিরা।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল হাই বলেন, পশু পাখির বন্যা পরবর্তী রোগ বালাই রোধে প্রতিটি উপজেলায় ভ্যাটেনারি সার্জনের নেতৃত্বে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিমের কর্মীরা বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। এবং তাদের পোষা প্রাণীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছেন। এছাড়া বন্যার পানিতে ডুবে থাকা ঘাস ও লাতা পাতায় জীবাণু সংক্রম হতে পারে বিধায় ওইসব ঘাস গরু মহিষদের না খাওয়ানো জন্য দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।
এছাড়া মানবিক কারণে বন্যা কবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গরু ছাগলকে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৯৪৮টি গোবাদি পশুকে টিকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ১২হাজার ৮০০ হাঁস মুরগীকেও টিকা প্রদান করা হয়েছে। আর চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তিন হাজার ৩৮৪টি পশু পাখিকে। বন্যা পরবর্তী সময়ে যেন মহামারি দেখা না দেয় তার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করতে গ্রামে গ্রামে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। ক্ষতির চিত্র প্রতিনিয়ত বাড়ছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, এর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রতিদিন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, গোবাদি পশু লালন পালনকারিদের সহায়তা করার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধপত্র মজুদ রয়েছে তার কার্যালয়ে।
প্রসঙ্গত, বন্যার আগে জেলা জুড়ে গরুর শরীরে মহামারী আকারে লাম্ফিং ডিজিস ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এক লাখ ৫২ হাজার গরুকে ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়। বর্তমানে এই রোগটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ।