যেখানে সব সময় থাকতো নৌকার চলাচল। মাঝিদের মনে থাকতো ভাটিয়ালি সুরের গান। মহানন্দে নৌকা বেয়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যাওয়া যেন শুধু স্মৃতি। রুই, কাতল, চিতল, গজার, শৌল, বোয়াল, শিং, মাগুরসহ নানা জাতের দেশীয় মাছের ভরপুরের গল্পটাও যেন আজগবী। এ নদীতে শতশত জেলেদের কোলাহল যেন মিরকি নদীর আদিকথা। এখন রাখালেরা এ নদীতে গরু চড়ায়। ক্ষরশ্রোতা এ মিরকি নদীর ওপর গড়ে ওঠেছে ঘরবাড়ি। পরিণত হয়েছে আবাদি জমি। ভারত থেকে নেমে আসা রাক্ষুসি সোমেশ্বরীর আর পাগলা নদীর গতিপথ শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার মিরকি নদীর বুকে জেগে ওঠেছে চর। কালের স্রোতে ধীরে ধীরে ভরাট হয়েছে নদীটি। যেন নতুন প্রজন্মের কাছে মিরকি নদী এখন শুধুই কল্পকাহিনী। কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে মিরকি নদী।
স¤প্রতি সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শ্রীবরদী উপজেলা সদর বাজার সংলগ্ন ছিল মিরকি নদী। এ নদীর পূর্বে শ্রীবরদী সদর বাজার, দক্ষিণে বনপাড়া, চককাউরিয়া, ঝালুপাড়া, পশ্চিমে পুটল, উত্তরে গেরামারা ও কাকিলাকুড়া এলাকা। সদর বাজার সংলগ্ন ছিল নৌকা রাখার শান বাঁধানো ঘাট। এ ছাড়াও নয়াপাড়া, গেরামারা, কাকিলাকুড়াসহ কয়েকটি স্থানে ছিল ছোট ছোট ঘাঁটি। এ নদীটি ঘিরে শ্রীবরদীর তৎকালীন শম্ভূগঞ্জে গড়ে ওঠেছিল বিশাল পাটের বাজার। এ ঘাট হতে নৌকায় পাট বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো জামালপুরের জেলা সদরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। নানা পন্য সামগ্রী নিয়ে বেদেনীরা আসতো পাল তোলা নৌকায়। থাকতো প্রায় সারা বছর। চলাচল করতো এ ঘাট থেকে ও ঘাটে। মিরকি নদীতে বেদেনীদের পালতোলা নৌকায় আনাগোনায় যোগ হতো এক নতুন মাত্রা। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেও এ নদীর গভীরতা ছিল ২০/২৫ ফুট। ওই সব এখন শুধু স্মৃতি বা কল্পকাহিনী। নদীর ওই জৌলুস হারিয়েছে প্রায় ৩৫ বছর আগেই। পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছরই এ নদীতে পড়ছে পলিমাটি। এতে ঐতিহ্যবাহী এ নদীর অস্তীত্ব বিলীন হচ্ছে। মাত্র দু’যুগে ১৩/১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর বুকে জেগে ওঠেছে চর। এ চরে প্রায় এক যুগ ধরে চলছে ইরি বোরো চাষাবাদ। প্রায় ১২ কিলোমিটারের অস্তীত্ব বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। রয়েছে শুধু মিরকি নদী।
মিরকি নদীর দু’পাড়ে কৃষকরা জানায়, এ নদীর বুকে পলিমাটি পড়ে অধিক উর্বর হয়েছে। তাই এ জমিতে সারের প্রয়োজন হয়না। এমনকি সেচ সুবিধা থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে ইরি বোরো চাষাবাদ। নদীর বুকে চাষাবাদ করে পার্শ্ববর্তী জমির মালিকরা বছরের ৫/৬ মাসের খাবার ধান ঘরে তুলছেন। এসব কৃষকের সংখ্যা পাচঁ শতাধিক।
নদীটিতে জেগে উঠায় আর নৌকা চলে না। এক সময় যেসব জেলে এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। সেই সব জেলে স¤প্রদায়ের অনেকের জীবনে নেমেছে দূর্ভোগের অমানিষা। কেউবা পেশা বদল করে চলে গেছে অন্যত্র। ফলে মৎস এলাকাটি হয়েছে মৎসশূন্য। সচেতন মানুষ ও জেলেরা মনে করেন, নদীটি ড্রেজিং করা হলে বছরে কোটি কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হতে পারে। এ নদীতে হতে পারে মৎস খামার। দেশে মেটাতে পারে মাছের চাহিদা। হতে পারে হাজারো বেকারের কর্মসংস্থানের নতুন পথ।