‘বন্ধু ছিলাম, বন্ধু আছি, বন্ধু থাকব’ এই স্লোগানে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো শেরপুর সদরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বিদ্যালয় ‘যোগিনীমুড়া উচ্চ বিদ্যালয়’র এসএসসি- ২০০২ ব্যাচের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান।
শনিবার (১ জুলাই ) দুপুরে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফরিদুর রহমান ফরিদের সভাপতিত্বে শুরু হয় এসএসসি-২০০২ ব্যাচের মিলন মেলার অনুষ্ঠান। ফুল দিয়ে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষকদের বরণ করে নেয় আয়োজক শিক্ষার্থীরা।
এরপর প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ বক্তব্য, শিক্ষকদের ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের পক্ষ হতে শিক্ষকদের নিয়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি শেষে ২০০২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নাচ-গান ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের গান আর বাদ্য-বাজনার তালে বন্ধুরা একে অপরের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পুরো আয়োজনে আনে ভিন্ন মাত্রা।
দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের পেয়ে উচ্ছ্বাসে চোখ মুখ যেন চকচক করছিল বন্ধুদের। দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকায় অনুষ্ঠানে এসে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। খোঁজখবর নেন পুরনো বন্ধু এবং তাদের পরিবার-পরিজনের। অনেকেই এ সময় স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণায় মেতে ওঠেন। অনেকে বহুদিন পর প্রিয় বন্ধুকে পুনরায় কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এভাবে অনুষ্ঠানস্থল এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে একে অপরকে। ভুলে যায়নি নিজেদেরকে ক্যামেরাবন্দী করতে। আবার কেউ কেউ ত ব্যস্ত ছিলো সেলফি জোনে সেলফি তুলতে।
২০০২ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ভাঙ্গুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ হাসান খাঁন লাবন বলেন, ‘বন্ধুত্বের টানে, বন্ধুর পানে আমরা ২০০২ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ ২১ বছর পর একত্রিত হয়েছি। কতদিন পরে যে সবাই স্কুলে এসেছি, মনে হচ্ছে ক্লাসে স্যারদের সামনে বসে আছি। এই অনুভূতি, আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’
আয়োজক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মজনু মিয়া (পিআইও) বলেন, ‘আমাদের এই মিলন মেলা ঈদের আনন্দ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা আজ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সবাইকে শুভেচ্ছা এবং ঈদ মোবারক। এক সময় আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করলেও, জীবিকার তাগিদে অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। কেউ রাজধানী ঢাকা, কেউ চট্টগ্রাম- কেউবা আরও দূরদূরান্তের জেলায়। জীবনের এমনই নিয়ম। এখন হয়তো কালেভদ্রে সেসব বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। ফলে আমরা চেয়েছিলাম এবারের ঈদের ছুটিতে সবাই একত্রিত হতে। সবাইকে দীর্ঘ ২১ বছর পর পেয়ে অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হলো।’
আয়োজক শিক্ষার্থী কৃষিবিদ নিয়াজ মোর্শেদ পলাশ, এমদাদুল হক মিলন, , প্রকৌশলী তারিকুল ইসলাম তারেক, রুবিউল ইসলাম রুবেল, সেনাসদস্য আমিনুল ইসলাম মিলন, মিনহাজ উদ্দিন মিনু, কৃষিবিদ আল হেলাল বলেন, ‘কৈশোরের বন্ধুত্ব কখনও হারায় না, হারিয়ে যাবার নয়। জীবন জীবিকার তাগিদে আমরা হয়তো ব্যস্ত থাকি, কিন্তু ছেলেবেলা কখনও মুছে যায় না, অমলিন হয়ে থাকে স্মৃতিপটে। এ কারণে জীবন চলার পথে যতো মানুষের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হোক না কেন, স্কুলজীবনের বন্ধুত্বের মতো তারা কখনও স্মৃতিময় বন্ধুত্বের বন্ধন আর হয় না। জীবনের প্রকৃত বন্ধুই হলো স্কুল জীবনের খেলার সাথীরাই। তারাই প্রকৃত বন্ধু। এ কারণেই আমরা সবাই মিলে চেয়েছিলাম এমন একটা আয়োজন করতে যেখানে সবাই একসঙ্গে দীর্ঘ ২১ টি বছর পর একত্রিত হতে পারবো। এমন সফল একটি আয়োজন আমাদেরকে ছেলেবেলা, স্কুলজীবনকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা আরো বড় পরিসরে বন্ধুদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই। আজকে সেই স্বপ্নের পথে আমাদের চলা শুরু হলো। আমরা আমাদের মরহুম শিক্ষকদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি আর শ্রদ্ধেয় সেসকল শিক্ষাগুরু জীবিত আছেন, তাদের নেক হায়াত কামনা করছি।’
আয়োজক শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া বন্ধুদের সহায়তা, অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়া, বন্ধুদের যে কোনো বিপদে পাশে থাকাসহ দেশের যে কোনো দুর্যোগে মানবিক কর্মকাণ্ডে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করবে।’
এসময় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ২০ হাজার টাকা প্রদান করেন ও প্রত্যেক বছর একটি করে অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
সেইসময়কার স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন শিক্ষক বাবু সুকুমার চন্দ্র দে, আলহাজ্ব নাসির উদ্দীন খাঁন, আলহাজ্ব আশরাফ আলী বিএসসি, মিনাল ক্লান্তি, জুলহাস আলী, প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান, সহকারী প্রধান শিক্ষক ইসরাত জাহান রিতা, সিনিয়র শিক্ষক এনামুল ইসলাম।
বক্তব্যকালে বাবু সুকুমার চন্দ্র দে বলেন, ‘এ এলাকার মানুষদের পড়ালেখা শেখানোর জন্য সেই ১৯২০ সালে বিশিষ্ট ধর্মগুরু ও বুজুর্গ ফসিহ উদ্দিন পীর সাহেব একটি প্রি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করেন। পরবর্তীতে এটি পর্যায় ক্রমে হাইস্কুলে রুপান্তর হয়৷ আমি ১৯৬৬ হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ স্কুলে সেবা দিয়েছি। হাজারো স্মৃতি রয়েছে আমার এ স্কুলঘিরে। বাই সাইকেল চালিয়ে আসতাম, আশেপাশের ২০ গ্রামের সবাই আমাকে মাস্টারমশাই বলেই চিনতো৷ বাঁশের সাঁকো আর কাঁদা মাড়িয়ে নিয়মিত স্কুলে আসতাম। আমার জীবনে একটি দিন স্কুল ফাঁকি দেয়নি৷ শিক্ষার্থীদের অনেক শাসন করেছি। সবার কাছে আর্শিবাদ চাই।’
এসময় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য শাহজাহান তালুকদার, আমিনুল ইসলাম ও আলমগীর আল আমিন উপস্থিত ছিলেন।
২০০২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন রুমান, আবদুল আল মামুন (নয়ন), রফিকুল ইসলাম, নূরনবী, রাসেল মিয়া, সুজন আহম্মেদ, শুকুর আলী, সোহেল রানা, সাইদুল ইসলাম, প্রভাষক আতিকুর রহমান, হামিদুর (হামিদ), মাসুম মিয়া, রকিবুল ইসলাম, মোক্তার আলী, নজরুল ইসলাম, লাকি আক্তার, রেখা রাণী, কচি খাতুন, চামেলি আক্তার, ছামিদুল হক, ইবনে মিজান রুমান, মুহাম্মদ আলী, মকছেদ আলী, মিঠুন, মনোয়ার হোসেন, শেখ আহম্মেদ, লিটন মিয়া, আল হেলাল, মমেনা আক্তার, হারুন মিয়া, সুজন আহম্মেদ, সাখওয়াত হোসেন, মনিরুজ্জামান, আব্দুল আলিম, ফারুক আহম্মেদ, নূরনবী (বাবু), মিলন, দ্বীন ইসলাম প্রমুখ।
সন্ধ্যার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মিলন মেলা শেষ হয়।