মৃত্যুর পর আর লাশ সৎকারে বিড়ম্বনায় পড়তে হবেনা হিজড়াদের। লাশ দাফনের জন্য কবরস্থান পেলো শেরপুরের হিজড়ারা। শেরপুরের বিদায়ী পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান এবং তার সহধর্মিনী পুনাক সভাপতি সানজিদাহক মৌ নিজেদের ব্যক্তিগত অর্থায়নে শেরপুরের হিজড়াদের জন্য কবরস্থানের জায়গা কিনে দিয়েছেন।
সদর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের আন্ধারিয়া-সুতিরপাড় এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠির গুচ্ছ গ্রামের পাশেই ১১ শতক জমি দলিল মুলে ক্রয় করে কবরস্থান নির্মাণ করে দিয়েছেন। চারদিকে নির্মাণ করা হয়েছে সীমানা প্রাচীর। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। শুক্রবার (২১ জুলাই) বিকেলে হিজড়াদের কবরস্থানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বিপিএম।
এসময় পুলিশ সুপারপত্নী সানজিদাহক মৌ সেখানে ৩টি গাছও রোপন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সোহেল মাহমুদ, সদর থানার ওসি বছিরআহমেদ বাদল, জনউদ্যোগ আহবায়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, শিক্ষাবিদ শিব শংকর কারুয়া, সংস্কৃতিকর্মী এসএম আবুহান্নানসহ হিজড়া জনগোষ্ঠির সদস্য ও স্থানীয় সুধীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কবরস্থান পেয়ে উচ্ছ¡সিত হিজড়া জনগোষ্ঠির সদস্যরা। শেরপুর জেলাহিজড়া কল্যাণ সমিতির সভাপতি নিশি সরকার বলেন, আমরা কৃতজ্ঞ পুলিশ সুপার এবং তার সহধর্মিনীর প্রতি। তারা আমাদের আনন্দে শরীক হয়েছেন, শেষ বিদায়েও পাশে থাকার ব্যবস্থা করলেন। মৃত্যুর পর আমাদের মরদেহ দাফনের জন্য কবরস্থান নির্মাণ এবং লাশ সৎকারের দায়িত্ব নেওয়ায় আমরা তাদের প্রতি চিরঋণী হয়ে রইলাম।
নাগরিক প্ল্যাট ফরম জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটির আহবায়ক শিক্ষক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, গত বছরের ৩০ অক্টোবর শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থার ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান। সাথে ছিলেন তার সহধর্মিনীও। সেই অনুষ্ঠানেই তৃতীয় লিঙ্গ ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠির মৃত্যুর পর লাশ সৎকার নিয়ে বিড়ম্বনার বিষয়টি তারা অবগতহন। তখই তারা কামারিয়ার সরকারি গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারি হিজড়াদের জন্য পৃথক কবরস্থান নির্মাণের ঘোষনা দিয়েছিলেন। সদ্য জামালপুর জেলায় বদলী হওয়া এই পুলিশ সুপার শেরপুর থেকে বিদায়ের আগেই হিজড়াদের লাশ দাফনের জন্য কবরস্থানটির ব্যবস্থা করলেন। এজন্য তাদেকে অবিনন্দন জানাই।
পুলিশসুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, কবরস্থান নির্মাণের মাধ্যমে আমি কেবল একটি মানবিক কাজে সামিল হতে পেরেছি। আমি বিশ্বাস করি সকলের ভালোবাসায় একদিন হিজড়ারা অব্যশই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো, সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে একই মর্যাদায় বাঁচতে পারবো। যেখানেই থাকিনা কেনো, শেরপুরের হিজড়াদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা অব্যাহত থাকবে। তিনি এখানকার হিজড়াদের কারো মৃত্যু হলে তাকে জানানো এবং লাশ কাফন-দাফনের সকল ব্যয় বহন করারও ঘোষণা দেন।
উল্লেখ, নাগরিক প্লাটফরম জনউদ্যোগের অনুপ্রেরণায় ২০১৮ সালে গঠন করা হয় শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থা। তৎকালীণ জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব- এর প্রচেষ্টায় জেলা সমাজ সেবা বিভাগ জেলার ৫২ জন হিজড়াকে তালিকাভুক্ত করে এবং আত্মকর্মসংস্থানমুলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তৎকালীণ পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তালিকাভুক্ত সকল হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকাভুক্ত করা হয়। জেলা প্রশাসনের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহায়তায় শেরপুর সদরের ১২ নং কামারিয়া ইউনিয়নের আন্ধারিয়া সুতিরপাড় এলাকায় ২ একর খাসজমির ওপর নির্মিত হয় সরকারীভাবে দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠির গুচ্ছ গ্রাম প্রকল্প। ২০২১ সালের ৭ জুন তৃতীয় লিঙ্গ হিজড়া জনগোষ্ঠির গুচ্ছগ্রামে ৪০ জন হিজড়ার মাঝে জমিসহ ঘর প্রদান করে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর থেকে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, সংসদ সদস্য হুইপ আতিউর রহমান আতিক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে হিজড়াদের উন্নয়নে।