শস্য ভান্ডার খ্যাত শেরপুরের নকলা উপজেলায় এ বছর শশার বাম্পার ফলনে ভাগ্য বদল হয়েছে অন্তত দেড়শতাধিক কৃষক পরিবারের। এ সবজি চাষের মধ্যদিয়ে সচ্ছল ভাবে দিন চলার পথ খোঁজে পেয়েছেন তারা। পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা; তারাও হয়েছে আত্মনির্ভরশীল।
তাদের উৎপাদিত শশা গুণগত মান ভালো হওয়ায় রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তাছাড়া বিষমুক্ত হওয়ায় স্থানীয় ভাবেও চাহিদা বেড়েছে। শশা চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন কারীদের মধ্যে সুজন ও মোজাম্মেল তারা দুই ভাই সবার নজর কেড়েছেন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় পড়ালেখায় বেশি এগুতে না পারলেও শশা চাষে তারা সর্বোচ্চ সফল হয়েছেন। দশ বছর যাবৎ এই সবজি চাষ করে চমক দেখিয়ে তারা উপজেলায় শশা চাষে মডেলে পরিণত হয়েছেন। তাদের সফলতা দেখে উপজেলার অনেকেই শশা চাষে ঝুঁকছেন।
পাইস্কা গ্রামের শশা চাষী সুজন জানান, ২০০৮ সালে মাত্র ৩৫ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে সম্পূর্ণ বিষমুক্ত ভাবে ফেরোমন ফাঁদ ও পার্চিং ব্যবহার করে শশা চাষ করে সে বছর প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা লাভ হওয়ায় শশা চাষের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরের বছর থেকে পর্যায়ক্রমে শশা আবাদ বৃদ্ধি করতে থাকেন তিনি।
এ বছর বিষ মুক্ত শশা উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনি দুই একর জমি প্রতি একর ২৫ হাজার টাকা বছর হিসেবে মোট ৫০ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে শশা চাষ করেছেন। জমি লিজ বাবদ, জমি তৈরী, ভেড়া দেওয়া, শ্রমিকের মজুরি, বীজ ও সারসহ দুই একর জমির শশা ক্ষেতে মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে তার শশা ক্ষেতে ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। অক্টোবরের ১৫ তারিখে হাইব্রিড-১০২, অলরাউন্ডার-২, চমক ও ইস্পাহানী-২ জাতের শশা বীজ বপন করার ৪৫ দিন পরে শশা তোলা শুরু করেন। দুই দিন পরপর প্রায় ১০০ মন করে শশা তোলেন তিনি।
শুরুতে প্রতিমণ ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা করে বিক্রি করা হলেও বর্তমানে প্রতিমণ শশা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে বিক্রি করছেন। তার তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত তিনি ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকার শশা বিক্রি করেছেন। কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে আরও ৩ লক্ষাধিক টাকার শশা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
এতে করে দুই একর জমিতে তিন মাসের এই সবজি হতে তার লাভ হবে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। আগামিতে শশার আবাদ বৃদ্ধি করবেন বলে তিনি নতুন করে আরও দুই একর জমি লিজ নিয়েছেন। লাভ বেশি হওয়ায় তার দেখাদেখি পাইস্কা এলাকার মোজাম্মেল, শফিক, শহিদুল, সুহেল, সালাম, মহিউদ্দিন, লিয়াকত, রহুল; মতো উপজেলার গৌড়দ্বার, চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা ও বানেশ্বার্দী ইউনিয়নের অনেক কৃষক বাণিজ্যিকভাবে শশা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, আইপিএম কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্ত, নকলার সহযোগিতায় জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা প্রদর্শণীর আওতায় ৩৩ শতাংশ জমিতে শশা চাষ করে তিনি অধিক লাভবান হয়েছেন। ওই প্রদর্শণীর আওতায় রুণিগাঁওয়ের নবী হোসেন, পাঠাকাটার শফিকুল, শহিদুলসহ ৪জন ইতি মধ্যে লাভবান হচ্ছেন। তাছাড়া চরভাবনা, পাইস্কা, সাইলামপুরের আরও ৪ জনকে জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা প্রদর্শণীর আওতায় শশা চাষ করার প্রক্রিয়া চলছে। ওইসব ক্ষেতের শশা বিষমুক্ত হওয়ায় স্থানীয় ভাবে চাহিদা দ্বিগুণ। অনেক সচেতন মানুষ সরাসরি ক্ষেত থেকে শশা কিনে অনেন।
চাষীরা জানান, গত ৮ থেকে ১০ বছর যাবৎ শুধু শশা চাষের তিন মাসের আয় দিয়েই তাদের সংসারে সারা বছরের খরচসহ ছেলে মেয়েদের শিক্ষা খরচ বহন করে আসছেন।
উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, নকলায় জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা প্রদর্শণীর আওতায় শশা চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দিনি দিন বিষমুক্ত শশার আবাদ বাড়ছে। তাতে কৃষক আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। ভোক্তারা পাচ্ছেন বিষমুক্ত সবজি।
উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ভাদ্র মাসের শেষদিকে শশার বীজ রোপন করার ৪২ দিন থেকে ৪৫ দিন হতেই শশা তোলা শুরু হয়ে চলে অগ্রহায়ন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। অপেক্ষাকৃত উচু ও দো-আঁশ মাটি হওয়ায় নকলার মাটি শশা চাষের জন্য উপযোগী। তাই দিন দিন শশা চাষির সংখ্যা বাড়ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর জানান, এ বছর উপজেলায় ২৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে শশার আবাদ করা হয়েছে এবং ফলনও ভাল হয়েছে। তাছাড়া নিজে খাওয়ার জন্য শশার আবাদ হয়েছে আরও অন্তত ১০ হেক্টর জমিতে। তিনি আরও বলেন হাইব্রিড-১০২, হাইব্রিড অলরাউন্ডার-২ জাতের শশা বেশি চাষ করা হয়েছে।
দুই মাস ব্যাপী একটি গাছ হতে ১২ থেকে ১৫ বার শশা তোলা সম্ভব, যা অন্যকোন ফসলে কল্পনা করা যায়না। যে কেউ চাইলে শশা চাষের মাধ্যমে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারেন। শশা চাষিদের সার্বিক সহযোগীতা দিতে কৃষি বিভাগ সব সময় কাজ করছে বলেও তিনি জানান।