একেই বলে মধুর প্রতিশোধ। গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে ফিরতি লেগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এগিয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি। কিন্তু বাঁশি বাজানোর কয়েক মিনিট আগের ভেল্কিবাজিতে সিটিকে বিদায় করে ফাইনালে উঠেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এবারও সেমিফাইনালে সেই রিয়ালেরই মুখোমুখি হলো ম্যান সিটি।
প্রথম লেগে রিয়ালের মাঠে মাঠে গিয়ে ১-১ গোলে ড্র করে এসেছিল পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। সিটি সমর্থকদের মনের দুরু দুরু ভয়, ফিরতি লেগে না আবার ম্যাজিক দেখিয়ে বসে স্প্যানিশ ক্লাবটির ফুটবলাররা! কিন্তু সবসময় ম্যাজিক কাজ করে না। সেটা অন্তত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন কার্লো আনচেলত্তি। ম্যান সিটি যে নিজেদের মাঠে কতটা দুর্ধর্ষ, বুঝতে পেরেছে রিয়ালের ডিফেন্স।
লজ ব্লাঙ্কোজদের ডিফেন্সকে ছিন্নভিন্ন করে চারবার পোস্টে বল জড়িয়েছে ম্যানসিটি। ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামে ৪-০ গোলে জয়, দুই লেগ মিলিয়ে রিয়ালকে ৫-১ ব্যবধানে হারিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠে গেলো ম্যানচেস্টার সিটি। ১০ জুন ইস্তাম্বুলের ফাইনালে ইন্টার মিলানের মুখোমুখি হবে সিটিজেনরা।
ম্যানসিটির হয়ে রিয়ালের জালে দুবার বল জড়িয়েছেন পর্তুগিজ তারকা বার্নার্ডো সিলভা। বাকি দুই গোল করেছেন ম্যানুয়েল আকানজি এবং আর্জেন্টাইন তারকা হুলিয়ান আলভারেজ। আর্লিং হালান্ডের পরিবর্তে শেষ দু’-তিন মিনিটের জন্য মাঠে নেমেই গোল পেয়েছেন আলভারেজ। কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই আর্জেন্টাইন তারকা।
ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামে মাঠে নামার আগে রিয়াল মাদ্রিদের সামনে ছিল ইতিহাসের অনুপ্রেরণা। যারা গত ৯টি মৌসুমের মধ্যে ৫বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গত আসরেও প্রায় প্রতিটি রাউন্ডে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ মুহূর্তের ম্যাজিকে ফাইনালে উঠে শিরোপা জয় করেছে কার্লো আনচেলত্তির শিষ্যরা।
আর অন্যদিকে ম্যানসিটির সামনে ছিল নতুন ইতিহাস গড়ার হাতছানি। ঘরের মাঠে এমনিতেই তারা অপরাজেয়। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এবং প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা।
এর আগে একবার ফাইনালে উঠেও চেলসির কাছে হারতে হয়েছিলো তাদের। এবার ইন্টার মিলানকে হারাতে পারলেই ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলবেন হালান্ড, কেভিন ডি ব্রুইন, বার্নার্ডো সিলভা কিংবা হুলিয়ান আলভারেজদের হাতে উঠে যাবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা।
প্রথমার্ধেই রিয়াল মাদ্রিদকে নাচিয়ে চেড়েছেন বার্নার্ডো সিলভা। শুধু প্রথমার্ধ কেন, পুরো ম্যাচেই রিয়ালকে দাঁড়াতে দেয়নি সিটির ফুটবলাররা। কি গতি আর কি ড্রিবলিং! অসাধারণ পাসিং ফুটবল, ডিফেন্সে রিয়ালের আক্রমণ ঠেকিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে বল নিয়ে উঠে আসা- এ কথায় সিটির পেছন পেছন দৌড়াতে হয়েছে রিয়াল ফুটবলারদের।
পেপ গার্দিওলার নিখুঁত পরিকল্পনার সামনে স্রেফ শিশুর মত হয়ে গিয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটি যখন যেভাবে চেয়েছে, রিয়ালকে নিয়ে সেভাবে খেলেছে তারা।
বার্নার্ডো সিলভার জোড়া গোলে প্রথমার্ধ শেষে ২-০ গোলে এগিয়েছিলো ম্যানসিটি। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যানুয়েল আকানজির নামে গোল লেখা হলেও, সেটি ছিল মূলত রিয়াল ডিফেন্ডার এডার মিলিতাওয়ের আত্মঘাতি গোল। শেষ মুহূর্তে হুলিয়ান আলভারের রিয়ালের পরাজয়ের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন।
শুরুতেই থিবো কুর্তোয়ার দৃঢ়তায় গোল হজম করা থেকে বেঁচে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। আর্লিং হালান্ডের দুর্দান্ত এক হেড এবং কেভিড ডি ব্রুইনের ফ্রি-কিক থেকে ভেসে আসা বল থেকে দলকে রক্ষা করেন কুর্তোয়া।
কিন্তু টানা চাপের মুখে রেখে ২৩তম মিনিটে গোল আদায় করে নেয় পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। কেভিন ডি ব্রুইনের ডিফেন্সচেরা পাস ধরে অসাধারণ এক শটে রিয়ালের জালে বল জড়িয়ে দেন বার্নার্ডো সিলভা। ১৫ মিনিট পর, ম্যাচের ৩৭তম মিনিটে দ্বিতীয় গোল করেন সিলভা। ইলকায় গুন্ডোগানের সেট করা বলকে দুর্দান্ত এক হেডে রিয়ালের জালে জড়িয়ে দেন সিলভা।
১৪ বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ প্রথমার্ধে গোলের কোনো সুযোগই তৈরি করতে পারেনি বলতে গেলে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে কার্লো আনচেলত্তির শিষ্যদের কিছুটা ধারালো মনে হচ্ছিলো। কিন্তু কোনোভাবেই একটি মানের আক্রমণ তৈরি করতে পারেনি এবং গোলের সুযোগও যে কারণে পায়নি তারা। ৭৩ মিনিটে বরং ম্যানসিটির একটি দুর্দান্ত চেষ্টা রুখে দেন গোলরক্ষক কুর্তোয়া। বক্সের একেবারে সামনে থেকে শট নেন আর্লিং হালান্ড। এবারও তাকে গোলবঞ্চিত থাকতে হলো।
এর ৩ মিনিট পরই আবার গোল। এবার কেভিড ডি ব্রুইনের কাছ থেকে বল পেয়ে ম্যানুয়েল আকাঞ্জি শট নেন। মিলিতাওয়ের গায়ে লেগে গতি পরিবর্তন হয়ে সেটি জড়িয়ে যায় রিয়ালের জালে।
৮৯তম মিনিটে আর্লিং হালান্ডকে তুলে মাঠে নামানো হয় হুলিয়ান আলভারেজকে। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপবিজয়ী এই ফুটবলার মাঠে নেমে দ্বিতীয় মিনিটেই গোল করে বসলেন। ৯১তম মিনিটে তার করা এই গোলেই দুই লেগ মিলিয়ে ৫-১ ব্যবধানে জয় তুলে নিয়ে ফাইনালে নাম লেখালো ম্যানসিটি।
ম্যাচের পর জোড়া গোলদাতা বার্নার্ডো সিলভা বলেন, ‘আমাদের জন্য এটা এক অসাধারণ রাত। আমরা জানতাম ম্যাচটা হয়তো অনেক কঠিন হবে। কিন্তু নিজেদের মাঠে এই মাদ্রিদকে ৪-০ গোলে হারানো ছিল অসাধারণ। ফাইনালে ওঠার আরও একটি অসাধারণ অনুভূতি যুক্ত হলো আমাদের। আশা করি আমরা এবার শিরোপাটা জয় করতে সক্ষম হবো।’