প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি শেরপুর সীমান্তের ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়। আর এই গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য শতগুণ বাড়িয়েছে গজনী অবকাশ কেন্দ্র। জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের ৯০একর জায়গাজুড়ে জেলা প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে গড়ে তোলা গজনী অবকাশ ভ্রমণ পিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। প্রতি শীত মৌসুমে দেশ বিদেশের লাখো পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয় এই পর্যটন কেন্দ্রটি।
পুরো বছরজুড়ে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও, পর্যটন সমৃদ্ধ শেরপুরে প্রতি শীতেই ভীড় বাড়ে দর্শণার্থীদের। সবুজের সমারোহে পর্যটকদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও বিনোদন দিতে এবার নতুন সাজে গজনী অবকাশ কেন্দ্র। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগের প্রথম জিপলাইন ও ক্যাবল কার। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে হেঁটে পার হবার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সুদীর্ঘ ঝুলন্ত ব্রিজ। সম্প্রতি এই তিনটি রাইড যুক্ত হবার পর থেকেই তরুণদের কাছে পছন্দের শীর্ষে এখন গজনী অবকাশ কেন্দ্র।
সারি সারি শাল, গজারি, সেগুন গাছের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আঁকাবাকা সড়ক, ছোট বড় মাঝারি টিলা আর চোখ জুড়ানো সবুজের বিন্যাস প্রকৃতিপ্রেমীদের নিশ্চিত দোলা দিয়ে যাবে। প্রবেশপথের পাশেই লেকে বোটিং আর তার উপর দিয়ে জিপলাইন। পাহাড়ের বুক জুড়ে তৈরী হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে। পায়ে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে।
রয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সুদীর্ঘ ঝুলন্ত ব্রিজ। তার পাশেই বসানো হয়েছে ক্যাবল কার। পুরো পরিবার একসাথে ক্যাবল কারে চড়ে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। তার নীচে পাহাড় ঘেঁষে পাথরে বসে আড্ডা আর ওয়াকওয়ের পাশে লেকের ধারে তৈরী হচ্ছে মিনি কফিশপ। চিড়িয়াখানায় যুক্ত করা হয়েছে নতুন করে প্রায় চল্লিশ প্রজাতির প্রাণী। পড়ন্ত বিকেলে ছোট ছোট নৌকায় করে ঘুরার জন্য রয়েছে লেক। লেকের বুকে নৌকায় চড়ে পাহাড়ের পাদদেশে কফি আড্ডা আর গান, এখানে আগত দর্শণার্থীদের জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা তৈরী করবে।
গারো মা ভিলেজেও ছোঁয়া লেগেছে নতুনত্বের। মাশরুম ছাতার নীচে বসে বা পাখি ব্রেঞ্চে বসে পাহাড়ের ঢালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, দিগন্তজোড়া ধান ক্ষেত আর পাহাড়ী জনপদের ভিন্ন জীবনমান উপভোগ করা যাবে খুব সহজেই। আদিবাসীদের সংস্কৃতি চর্চা ও পর্যটকদের এই সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে স্থাপন করা হচ্ছে সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র।
স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর। আগত দর্শণার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে জাদুঘরে রাখা হয়েছে জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস ও স্থিরচিত্র। পাশেই রয়েছে আদিবাসী জাদুঘর। বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসীদের জীবনমানের নানা ইতিহাস ও স্থিরচিত্র নজর কাড়বে পর্যটকদের।
আগত শিশু দর্শণার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্কের পাশাপাশি এবার নতুন যুক্ত হচ্ছে শিশু কর্ণার। সাথে আছে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং কর্ণার। পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর- এই ¯েøাগানে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং এর জন্য নির্মিত এই ব্র্যান্ডিং কর্ণারে জেলার বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বলিত ছবি, পুস্তক, ভিডিও চিত্র থাকবে। জেলার ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য তুলসীমালা চালের প্রদর্শন ও বিক্রির জন্যও থাকছে নির্দিষ্ট স্থান।
শেরপুর জেলা শহর থেকে আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই অবকাশ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের পর থেকেই প্রতি বছর ক্লান্ত জীবনের ব্যষÍতাকে ফেছনে ফেলে অবসরে হাজারো পর্যটক ভীড় করেন এই গজনী অবকাশ কেন্দ্রে। সবুজের মাঝেও বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরী হয়েছে। গজনীর প্রবেশমুখে মৎস্যকন্যা (জলপরী), ডাইনাসোরের প্রতিকৃতি, ড্রাগন, দন্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, পাতালপুরি, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার অন্যতম। এখানে নির্মিত ৮০বর্গফুট সুউচ্চ সাইট ভিউ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পাহাড়ী টিলার অপরূপ বৈচিত্রময় দৃশ্য। পড়ন্ত বিকেলে পাশর্^বর্তী ভারতের সুউচ্চ পাহাড় ও সীমান্ত দেখা যাবে এখান থেকেই।
গজনী অবকাশে আগতদের খাবার পরিবেশনে ব্যাক্তি উদ্যোগে ইতোমধ্যে খাবার হোটেল গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে অবকাশ বিরিয়ানী হাউজ ও পাঠান কনফেকশনারী অন্যতম। পাহাড় ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে দুপুরের খাবার অথবা স্ন্যাক্সের জন্য এসব দোকানে পাবেন কোমল পানীয়, কফি, ফাস্টফুড ও দুপুরের খাবার। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্দিষ্ট স্থানে আগতদের রান্নার জন্য সুব্যবস্থা করা হয়েছে।
শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে গজনী অবকাশে ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণাও শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বনভোজন বা শিক্ষা সফরে আসা শুরু করেছে। সেই সাথে বেচা কেনা বাড়ছে স্থানীয় দোকানগুলোতে।
নতুন আয়োজন সম্পর্কে শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, শেরপুর জেলা একটি পর্যটন সমৃদ্ধ জেলা। পর্যটনের বিকাশে জেলা প্রশাসন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার নতুন করে তিনটি রাইড যুক্ত করা হয়েছে। আমাদের আরো বেশকিছু পরিকল্পনা রয়েছে। দ্রæত সময়ের মধ্যেই আরো নতুন কিছু রাইড যোগ হবে গজনীতে। আগত দর্শণার্থীদের জন্য একটি মোটেল স্থাপনের জায়গা নেয়া হচ্ছে। মোটেল স্থাপন হলে শেরপুরে আগত পর্যটকদের রাত্রি যাপনের সমস্যা নিরসন হবে। এছাড়া পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ট্যুরিস্ট পুলিশ চেয়ে আবেদন পাঠিয়েছি। শেরপুরকে পর্যটনের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং করতে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সহযোগিতাও প্রয়োজন।
পর্যটনকে উপজীব্য করে ব্যান্ডিং হচ্ছে শেরপুর জেলা। পুরোনো স্থাপনায় নতুন রঙের আঁচড়ের পাশাপাশি নতুন স্থাপনাগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলে নতুন সাজে সাজবে গারো পাহাড়ে ঘেরা গজনী অবকাশ কেন্দ্র। করোনার ভয়াবহতা না বাড়লে ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকলে এই মৌসুমে বিপুল সংখ্যক দর্শণার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে গজনী অবকাশ কেন্দ্র এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।