মন্ত্রিসভায় আবারো পরিবর্তন আসতে পারে শিগগির। আগামী ১৭ মার্চ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন শুরু হওয়ার আগে মন্ত্রিসভার কলেবর বাড়াসহ নতুন মুখ যোগ হতে পারে। একই সঙ্গে দক্ষতার নিরিখে দায়িত্ব রদবদলও হবে কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর।
এবারের পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরকার আরো স্পষ্ট করতে চায়- মন্ত্রিসভার বাইরে দল ও দলের বাইরে মন্ত্রিসভাকে রাখা।
যে কয়েকজন প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও দলের কেন্দ্রীয় পদে রাখা হয়নি, তাদের পদোন্নতি হতে পারে। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়া ও দলের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় দায়িত্বে না থাকা কেউ কেউ এবার যোগ হতে পারেন।
‘চমকের মন্ত্রিসভায়’ জনপ্রিয় ও নতুন মুখ যোগ করে সরকার আরো ‘চমক’ দিতে চায় বলে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়।
ক্ষমতাসীন দলের সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভায় শিগগিরই আনো বড় ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। নতুন বছরের শুরু থেকেই মন্ত্রিসভায় রদবদলের চিন্তা ছিল সরকার প্রধান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার।
গত বছরের শেষ দিকে দলের জাতীয় সম্মেলন এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলনের পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ব্যস্ততা ছিল দলে।
নতুন বছরের শুরুতে ঢাকার জোড়া সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের কর্মসূচি সাজানো ও প্রধানমন্ত্রীর ইউরোপে সরকারি সফরসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা কর্মসূচির কারণে চলতি খ্রিস্টীয় বছরের শুরুতে মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল ও পুনর্বিন্যাস সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়, সরকার ও দলকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে নেওয়া এবং আরো গতিশীল মন্ত্রিসভা গঠনের লক্ষ্যে এবার রদবদল হতে পারে।
একই সঙ্গে দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় এক বছর দেড় মাসের মধ্যেও যথাযথ দক্ষতা প্রমাণ করতে না পারায় বাদ পড়তে পারেন কয়েকজন। তাদের পরিবর্তে সাবেক, অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত কয়েকজন মন্ত্রী যোগ হতে পারেন। কয়েক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর পরিবর্তন হতে পারে।
এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন বিবেচনায় যেসব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দক্ষতা তেমন সন্তোষজনক নয়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে পারেন।
গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার দপ্তর পুনর্বণ্টন হওয়া তিনজনের বিগত সময়ে দায়িত্ব পালনের দক্ষতার মূল্যায়ন প্রাধান্য পেয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে। এমন পুনর্বণ্টন শিগগিরই আরো দেখা যাবে।
সূত্র জানায়, আলাপ-আলোচনায় বেশি আসছে নৌপরিবহন, পানিসম্পদ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর কথা। ওই তিন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে কেউ এখনো পর্যন্ত শপথ নেননি। রদবদলের মাধ্যমে ওই মন্ত্রণালয়গুলোতে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়।
গত বৃহস্পতিবার গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে এখন পূর্ণমন্ত্রীর পদ খালি। এ মন্ত্রণালয়ের কথাও আলোচনায় আছে। অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্যও অন্য মন্ত্রণালয়ের কাউকে এ মন্ত্রণালয়ে আনা হতে পারে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও নতুন কাউকে দেখা যেতে পারে। সরকারের পাঁচ মাসের মাথায় মন্ত্রিসভায় প্রথম পরিবর্তন এনে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।
এরপর থেকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে কেউ নেই। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে আছে জনপ্রশাসন এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে পারেন মন্ত্রিসভায় যারা নতুন যোগ হবেন অথবা যারা পদোন্নতি পাবেন।
সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভার যাত্রার শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার সবার প্রতি মাসের কার্যক্রম ও দক্ষতা মূল্যায়ন করছেন। অনেকের কাজের বিষয়ে তিনি সন্তুষ্ট হলেও কয়েকজনের বিষয়ে খুশি নন। তাদেরকে বাদ দিয়ে অভিজ্ঞ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নতুন কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভাকে আরো গতিশীল করতে চান তিনি।
দায়িত্ব পেয়েও ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকা, বিভিন্ন রকমের জনদুর্ভোগ নিরসনে ভূমিকা রাখতে না পারা, কিছু নিত্যপণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে না পারা এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও মন্ত্রিসভার থাকায় দলে সময় দিতে না পারা ইত্যাদি বিবেচনায় মন্ত্রিসভায় কিছু রদবদল হতে পারে। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেও দলে তারা নেতৃত্বে থাকবেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল হলে কিছু কারণে আলোচিত শীর্ষ ছয় নেতার মধ্যে কেউ কেউ ঠাঁই পেতে পারেন।
২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যৌথসভায় দলের ওই ছয় নেতাকে পুরস্কৃত করার কথা জানান দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান (সদ্য সাবেক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) দলের সর্বশেষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন।
এখন তাই বাকি চারজনের (আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, মেসবাহ উদ্দিন ও বাহাউদ্দিন নাছিম) মধ্যে কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় রদবদলের সময় টেকনোক্র্যাট কোটায় ঠাঁই পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
সরকারি দলের ওই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের মতে, ‘মন্ত্রিসভার বাইরে দলকে রাখার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটেছে গত ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে। নতুন বছরে পথ চলা শুরুর আগে দলকে সরকার থেকে যতটুকু সম্ভব আলাদা করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মন্ত্রিসভার সদস্য থাকায় দলীয় পদে কয়েকজনকে রাখা হয়নি।
এমনকি পদ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা থাকলেও মন্ত্রিসভায় থাকায় কয়েকজনকে এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে শেষ পর্যন্ত রাখা হয়নি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা থাকলেও তাদেরকে এবার রাখা হয়নি দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায়। তাই মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ যোগ হলেও দল ও সরকার আলাদা রাখার বিষয়গুলো বিবেচনায় থাকবে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভায় রদবদল হলে আবারো ফিরে আসতে পারেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের নামও আছে এ তালিকায়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের নামও আছে নতুন মুখের তালিকায়।
আলোচনায় আছেন সিরাজগঞ্জের একটি সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাবিবে মিল্লাত মুন্না। তিনিও মন্ত্রিসভায় যোগ হতে পারেন বলে জোর আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মহাজোট ও ১৪ দলের জোটের শরিক দলের কেউ মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নও থাকলেও এবারো শরিকদের কেউ যোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম। মন্ত্রিসভার নতুন মুখ হিসেবে আলোচনায় আছেন মূলত আওয়ামী লীগেরই নেতারা।
তথ্যমতে, নতুন মন্ত্রিসভায় ২০১৯ সালের ১৯ মে প্রথমবারের মতো স্বল্পপরিসরে পুনর্বিন্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে কাউকে সংযুক্ত করা কিংবা বাদ দেওয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের দায়িত্বে কাটছাঁট করা হয়।
এরপর গত বছরের ১৩ জুলাই সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফজিলাতুননেসা ইন্দিরাকে প্রতিমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো বর্তমান মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
একই দিন পদোন্নতি পেয়ে প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী হন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ইমরান আহমেদ। সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার তিন সদস্যের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক সূত্রমতে, দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গত কয়েক দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে মন্ত্রিসভায় নতুন করে কারা স্থান পাচ্ছেন ও কে কে বাদ পড়ছেন। তবে মন্ত্রিসভায় নতুন কারা স্থান পাচ্ছেন বা কারা সেখান থেকে বাদ পড়ছেন— তা একান্তই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার এখতিয়ার। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিনি যাদের চাইবেন, তাদেরই জায়গা হবে নতুন করে।
প্রধানমন্ত্রী ও তার দপ্তরই নির্ধারণ করবে, কখন মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ নেওয়া হবে। সংবিধানই প্রধানমন্ত্রীর এ ক্ষমতা নিশ্চিত করে।