বৃষ্টি উপেক্ষা করে দুই বছর পর শান্তিপূর্ণভাবে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত। মঙ্গলবার (৩ মে) সকাল সাড়ে ৮টা থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। তবুও শোলাকিয়া মাঠে ছিল মুসল্লিদের ঢল।
মঙ্গলবার সকাল ১০টায় শুরু হওয়া ঈদুল ফিতরের ১৯৫তম জামাতে ইমামতি করেন বড়বাজার মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা শোয়াইব বিন আব্দুল রব। নামাজ শেষে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। আয়োজকদের ধারণা, এবারের জামাতে প্রায় চার লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করেছেন
গতরাত থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিরা শহরে প্রবেশ করতে থাকে। ভোরে হাজার হাজার মুসল্লির পদচারণয় মুখর হয়ে উঠে কিশোরগঞ্জের রাস্তাঘাট। কেউ গাড়িতে চড়ে কেউবা পায়ে হেঁটে জামাতে অংশ নিতে আসেন। সকাল ৯টার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় শোলাকিয়া মাঠ। কড়াকড়ি নিরাপত্তার মধ্যে মুসল্লিরা মাঠে প্রবেশ করে জামাতে অংশ নেন।
দুই বছর পর শোলাকিয়ায় জামাত হওয়ায়, বহু মুসল্লি মাঠের আশপাশের রাস্তাগুলোতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছেন। মুসল্লিদের বিশ্বাস বেশি লোক একসাথে নামাজ আদায় করলে করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। তাই নানা ভোগান্তির পরও বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মুসল্লি শোলাকিয়ায় নামাজ আদায় করতে আসেন।
টাঙ্গাইল থেকে ঈদের জামাতে এসেছেন মো. করিম উল্লাহ। তিনি এবার নিয়ে চারবার শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেছেন। তিনি বলেন, প্রথমবার এ মাঠে নামাজ আদায় করে মনে একটা অন্যরকম শান্তি চলে আসে। রাতেই এখানে একটি হোটেলে এসে উঠেছিলাম। তারপর সকালে লাখো লাখো মুসল্লির সাথে জামাতে অংশ নেই। একসাথে এত মুসল্লির নামাজে অংশ নেওয়া এ মাঠের একটা দৃষ্টান্ত।
২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার পর থেকে শোলাকিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। দুই বছর পর জামাত হওয়ায় এবার তারচেয়েও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ওয়াচ দুটি টাওয়ারে স্নাইপিং রাইফেল নিয়ে দায়িত্বপালন করেন র্যাব সদস্যরা। বাকি চারটি ওয়াচটাওয়ারে ছিল পুলিশের সদস্য। নজরদারিতে আকাশে উড়ে পুলিশের বেশ কয়েকটি ক্যামেরা ড্রোন। মোতায়েন ছিল মাইন সুইপিং ও বোমা নিস্ক্রিয়করণ দল, পুরো মাঠ ও আশপাশের এলাকা ছিল সিসি ক্যামরার নজরদারিতে।
নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা মো. খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার বয়স এখন ৬৩ বছর। আমি ১০ বছর বয়সে প্রথম বাবার সাথে এ মাঠে ঈদের জামাতে এসেছিলাম। এবার আমি আমার ছেলে ও নাতিকে নিয়ে এসেছি। আমার নাতির বায়না ছিল এ মাঠে ঈদের জামাতে আসবে। কিন্তু গত দু’বছর করোনায় ঈদের জামাত না হওয়ায় আসতে পারেনি। তবে এবার মনে একটা তৃপ্তি পেয়েছি, নাতি ও ছেলেকে নিয়ে একসাথে জামাতে অংশ নিয়ে।
রেওয়াজ অনুযায়ী, জামাত শুরুর আগে শর্টগানের ৬টি ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। জামাত শুরুর ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি গুলি ছুঁড়ে নামাজ শুরুর সংকেত দেওয়া হয়।
পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, সকাল থেকেই পুরো মাঠ তল্লাশি করা হয়। শহরের যত অলিগলি আছে, সবখানে আমাদের নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছিল। সব মিলিয়ে চার স্তরের নিরাপত্তা ছিল শোলাকিয়ায়। পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব, আনসার সদস্যের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের পাশাপাশি মাঠে সাদা পোষাকে নজরদারি করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। আমরা খুব সন্তুষ্ট এত বড় একটি জামাত নির্বিঘ্নে শেষ করতে পেরে।
ঈদের জামাতকে ঘিরে শহরের মোড়ে মোড়ে নির্মাণ করা হয় শুভেচ্ছা তোরণ। রাস্তার দুইপাশে টাঙানো হয় রঙ-বেরঙের পতাকা ও ব্যানার। মুসল্লিদের সুবিধায় পুরো মাঠ ও আশপাশে খাবার পানির ব্যবস্থা রাখে পৌর কর্তৃপক্ষ। মাঠে তৎপর ছিল স্বাস্থ্যবিভাগের মেডিক্যাল টিম। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে স্কাউট সদস্যরা। সব মিলিয়ে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় মুখর ছিল গোটা শোলাকিয়া মাঠ। সকালে শোলাকিয়া এক্সপ্রেস নামে দুটি বিশেষ ট্রেন ভৈরব ও ময়মনসিংহ থেকে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে কিশোরগঞ্জে আসে।
জেলা প্রশাসক ও শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে শোলাকিয়ায় ঈদ জামাত হয়নি। তাতে সব মুসল্লিদের মনে একটি আক্ষেপ ছিল। আজকে লাখো লাখো মুসল্লিদের অংশগ্রহণে শোলাকিয়া মাঠ আবারো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সবার সার্বিক সহযোগিতায় সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে উপমহাদেশের একটি বড় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।