যে কোনো কারণে যে কোনো ব্যক্তির যে কোনো সময় মন খারাপ হতে পারে। সেটা পরীক্ষার খারাপ ফলাফল, স্বামী বা স্ত্রীর সাথে কলহ, রাস্তায় বা অফিসে পরিচিত-অপরিচিত যে কারো দুর্ব্যবহার, টিভির পর্দায় সিরিয়ালের প্রিয় চরিত্রের মৃত্যু বা দুর্ঘটনা, খেলায় নিজ দেশের হার- মন খারাপের কারণের ইয়ত্তা নেই। এ মন খারাপকে ‘বিষণ্নতা’ নামেই অভিহিত করা হয় অনেক সময়। এ বিষণ্নতা প্রকৃত বিচারে সাময়িক দুঃখবোধ, যা পরবর্তী যে কোনো আনন্দ-সংবাদ বা ইতিবাচক ঘটনা বা প্রিয় সঙ্গে দূর হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যখন বিষণ্ণতা রোগের কথা বলবো, বুঝতে হবে, সেটি স্বাভাবিক সাময়িক দুঃখবোধের চেয়ে আলাদা বিশেষ এক আবেগ-সংক্রান্ত মানসিক অসুস্থতা। যদিও অনেক সময় বিষণ্ণতা রোগটিকেও বলা বা লেখার সুবিধার্থে শুধু ‘বিষণ্নতা’ শব্দটি দিয়েই প্রকাশ করা হয়। ‘বিষণ্নতা’- এ শব্দটির প্রায়োগিক ভিন্নতার কারণেও বিষণ্নতা রোগের ব্যাপকতা আর ভয়াবহতা অনেকটা আড়ালে থেকে যায়।
বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিনের অধিকাংশ সময় মন খারাপ বা ভার হয়ে থাকে। দৈনন্দিন কাজের অধিকাংশ বা সব ক্ষেত্রেই তিনি আর আগের মতো আগ্রহ পান না। এমনকি আগে যেসব কাজ উৎসাহ ভরে করতেন, এখন সেসবেও আনন্দ বা উৎসাহ পান না। মনোযোগের অভাব দেখা দেয়। যে কোনো কিছুতেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়- ঘুম আসতে দেরি হয়, তাড়াতাড়ি ভেঙে যায় বা ঘুম ভাঙার পর আর আগের মতো সতেজ বা চাঙা লাগে না, এক ধরনের ক্লান্তি ঘিরে ধরে। খাওয়ায় অরুচি, ফলশ্রুতিতে ওজন কমতে থাকে। চিন্তা ও কাজের গতি ধীর হয়ে যায়। নেতিবাচক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মনে, অযৌক্তিক বা অতিরিক্ত অপরাধবোধে ভোগেন। নিজেকে এবং জীবনটাকে অর্থহীন মনে হতে থাকে। মারাত্মক ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগ নির্ণয় সংক্রান্ত গাইডলাইন ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেজ’ এবং আমেরিকার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের অনুসৃত গাইডলাইন ‘ডায়াগনোস্টিক এন্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিজঅর্ডার’- এর সর্বশেষ সংস্করণ অনুযায়ী এসব উপসর্গের অধিকাংশই টানা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে বিষণ্নতা রোগ বলা হয়।
সাম্প্রতিককালে বিষণ্ণতা রোগটির ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জোর দেয়া হচ্ছে। ২০১২ সালে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’-এর মূল ভাবনা ছিল ‘বিষণ্নতা : একটি বৈশ্বিক সমস্যা’। পাঁচ বছরের মাথায় গুরুত্ব বিবেচনায় ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ – এরই মূল ভাবনা হয়ে উঠেছে ‘বিষণ্নতা’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সারা বিশ্বে ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত। ২০০৫ সালে সারা বিশ্বে বিষণ্নতার হার যা ছিল, ২০১৫ সালে এসে তার তুলনায় এ হার বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। সারা বিশ্বে রোগ-জনিত অক্ষমতার শীর্ষ কারণ বিষণ্নতা রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ডা. মার্গারেট চ্যান বলেছেন, ‘এই নতুন উপাত্ত সব দেশের জন্যই মানসিক স্বাস্থ্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে একটি বার্তা।’ ২০০৩-০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষকদলের জরিপে দেখা গেছে, এদেশে ১৮ বছরের উপরের জনসংখ্যার ৪.৬% বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত। আমাদের চারপাশের ঘটনাবলী এবং সারা বিশ্বের উপাত্তের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, এদেশেও বিষণ্নতায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি।
যে কোনো বয়সের যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো সময় বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রিয় কারো মৃত্যু বা সম্পর্কচ্ছেদ, শারীরিক রোগ, মাদকাসক্তি প্রভৃতি বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়। বয়ঃসন্ধি ও তারুণ্যের প্রথম ভাগে, নারীদের সন্তান জন্মদানে সক্ষমতার বয়সে, বিশেষত প্রসবের পর পর এবং ষাট বছরের বেশি বয়সে মানুষের বিষণ্নতার ঝুঁকি বেশি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এদের প্রতি আলাদা মনোযোগ দিচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, বিষণ্নতা রোগ ব্যক্তিগত দুর্বলতার লক্ষণ মাত্র নয়। ‘আরে, মন খারাপ তো সবারই হয়’ – বলে বিষণ্নতা রোগকে হালকা করে দেখার আসলে সুযোগ নেই। বিষণ্নতা রোগ ব্যক্তির কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে বা নষ্ট করে দেয়। এমনকি অনেকেই দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ করতেও অসমর্থ হয়ে পড়েন। ফলে, পরিবার ও বন্ধু-স্বজনের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রসবের পর নারীর বিষণ্ণতা সন্তানের বেড়ে ওঠায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিষণ্ণতার সাথে অন্যান্য অসংক্রামক রোগের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, বেশি ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের ঝুঁকিও। একইভাবে সত্য উল্টোটাও। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মাদকাসক্তি- সব-ই বাড়ায় বিষণ্নতার ঝুঁকি। সবচেয়ে আশংকার ব্যাপারটি হচ্ছে, মারাত্মক ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা রোগীকে ঠেলে দিতে পারে আত্মহত্যার পথে। আর আত্মহত্যা বর্তমানে বিশ্বে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ।
তবে, বিষণ্নতা একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। রোগের তীব্রতা ভেদে ওষুধ অথবা সাইকোথেরাপি বা একই সাথে উভয় পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করা যায়। বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন, মনকে বিষণ্ন করে বা মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে এমন কথা বা কাজ এড়িয়ে চলতে হবে। বিষণ্নতার সময়ে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা ভালো। সুষম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে। পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে, তবে বেশি ঘুম নয়। সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর চর্চা করতে হবে। মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। রুটিনমাফিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতে হবে। উল্লেখ্য, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কিছুদিন ওষুধ সেবনের পর অথবা সাইকোথেরাপিস্টের সাথে সেশনে অংশগ্রহণের পর রোগী যখন ভাল বোধ করেন বা উপসর্গ কমে যায়, তখন রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন বা সাইকোথেরাপি সেশনে আর অংশ নেন না। ফলে, রোগীর সঠিক চিকিৎসা হয় না। এবং কিছুদিন পর রোগীর উপসর্গ আবার ফিরে আসে।
আবার, মানসিক রোগ নিয়ে যে কুসংস্কার সমাজে বিদ্যমান, তার-ই নেতিবাচক ফল হিসেবে এ রোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তিই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত থেকে যান। এমনকি, উচ্চ-আয়ের উন্নত দেশগুলোতেও, বিষণ্ণতায় আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকই সঠিক চিকিৎসার আওতায় আসেন না। সঠিক চিকিৎসা তো দূরের কথা- অজ্ঞতা, বিভ্রান্তি ও সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে বিষণ্নতার কথাই বলতে চান না আক্রান্তরা। না চিকিৎসককে, না পরিবার, না বন্ধুবান্ধবকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকাসক্তি বিভাগের পরিচালক ডা. শেখর সাক্সেনার মতে, ‘যারা বিষণ্নতা নিয়ে দিন যাপন করছেন, তাদের জন্য বিশ্বস্ত কারো সাথে কথা বলাই অনেক সময় চিকিৎসা ও আরোগ্য লাভের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।’ বিষণ্নতা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এ বছর ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল ভাবনা – “Depression: let’s talk” , যার অনুবাদ করা যেতে পারে – ‘আসুন, বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলি’। এ কথা বলা বা আলোচনা কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, কেবল মানসিক রোগ চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের মধ্যে নয়, বিষণ্ণতা নিয়ে কথা হোক সামাজিক পর্যায়ে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, প্রচারমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। সকল পর্যায়ে এ আলোচনার চর্চাই সচেতনতা বৃদ্ধি করবে, দূর করবে কুসংস্কার। বিষণ্ণতায় আক্রান্তরা নিঃসংকোচে প্রকাশ করবেন নিজেদের, বলবেন মনের কথা, পাবেন সঠিক চিকিৎসা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি (ওএসডি) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা।