ময়মনসিংহ প্রতিনিধি; দীর্ঘ তিন বছর গবেষণার পর কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা পিয়ালি মাছের রেণু উৎপাদনে সফল হয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা।
পরিবেশ বিপর্যয় ও অতি আহরণের ফলে এটি এখন সংকটাপন্ন মাছের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের এই সাফল্যে চাষের মাধ্যমে খাবার টেবিলে ফিরবে পিয়ালি।
বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, বগুড়া জেলার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর পিয়ালি মাছের রেণু উৎপাদনে সফল হয়েছেন।
এই মাছ দ্রুত বর্ধনশীল ও খুবই সুস্বাদু। মাছটি আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম ও লৌহসমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম পিয়ালি মাছে ৭৫০ মিলিগ্রাম মেথিয়োনিন, ৪২০ মিলিগ্রাম সিস্টিন, ৪৩০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৬৭০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৫০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ১২ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম জিংক, ২৫ মিলিগ্রাম আয়রন, ৮ দশমিক ২১ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ ও ১ দশমিক ৪০ মিলিগ্রাম কপার রয়েছে। অন্য অনেক দেশীয় ছোট মাছের তুলনায় এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণে এই মাছ অত্যন্ত কার্যকরী।
এবার খাবার টেবিলে আসছে চাষের পিয়ালি
গবেষক দলে ছিলেন প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডেভিড রিন্টু দাস, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ও মালিহা খানম।
ডেভিড রিন্টু দাস বলেন, ‘তিন বছর গবেষণার পর পাঁচজোড়া পিয়ালি মাছে এ বছর জুনের প্রথম সপ্তাহে ১:১ দশমিক ৫ অনুপাতে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর মাছগুলো ডিম ছাড়ে এবং ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পর নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু উৎপাদিত হয়।
‘ডিম নিষেকের হার ছিল প্রায় ৭৬ শতাংশ। বর্তমানে ইনস্টিটিউটের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে রেণুগুলো পালন করা হচ্ছে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যেই পিয়ালি মাছকে চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
এবার খাবার টেবিলে আসছে চাষের পিয়ালি
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, মে থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে নদীতে প্রজননক্ষম স্ত্রী পিয়ালি মাছ পাওয়া যায়। এ ছাড়া জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জলাশয়ে পিয়ালির পোনার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা আকারভেদে দেড় হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার।’
উপকেন্দ্রে আরও ২৫ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ নিয়ে গবেষণা চলছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, গবেষণায় এ পর্যন্ত পাবদা, গুলশা, টেংরা, বাটা, ফলি, মহাশোল, খলিশা, বৈরালী, জাতপুঁটি, গজার, আঙ্গুস, খলিসা, মেনি, বালাচাটা, দাতিনা, গুতুম, ঢেলা, বাতাসি ও পিয়ালিসহ বিলুপ্তপ্রায় ২৯টি প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
বিএফআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শাহা আলী জানান, পিয়ালি মাছ এলাকাভেদে জয়া, পিয়ালি বা পিয়াসী নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাসপিডোপারিয়া জায়া (Aspidoparia jaya)। এ মাছটি সিপ্রিনিডি (Cyprinidae) পরিবারভুক্ত মিঠা পানির একটি মাছ।
বাংলাদেশ (পদ্মা ও যমুনা এবং তাদের শাখা নদীতে), ভারত (আসাম, উত্তরাঞ্চল, উত্তরপ্রদেশ), নেপাল, ইরান, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও আফগানিস্তানে এই মাছের বিস্তৃতি রয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা, যমুনার শাখা নদীর এলাকার মানুষের কাছে মাছটি পরিচিত।
একসময় পদ্মা, যমুনা ও শাখা নদী এবং বাঙ্গালী ও আত্রাই নদীতে প্রচুর পাওয়া যেত এই মাছ।
শাহা আলী বলেন, ‘এই মাছ দৈর্ঘ্যে পাঁচ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর দেহ লম্বা ও পার্শ্বীয়ভাবে চাপা। পরিণত পুরুষ মাছের পেট হলুদাভ থাকে এবং স্ত্রী মাছের চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। স্ত্রী মাছের পেট ধবধবে সাদা ও হালকা স্ফীতাকার হয়।’
এবার খাবার টেবিলে আসছে চাষের পিয়ালি
বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বাঙ্গালী ও আত্রাই নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পিয়ালি মাছের পোনা সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়েছে। গবেষকরা পিয়ালি মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাবার সরবরাহ করেন।
তিনি জানান, প্রাকৃতিক জলাশয়ের পিয়ালি মূলত প্লাংকটন (শ্যাওলা) খেয়ে থাকে। তা ছাড়া বছরব্যাপী জেনেরিক সিস্টেম ইমেজ (জিএসআই) ও হিস্টোলজি পরীক্ষার মাধ্যমে পিয়ালি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। এ প্রজাতির মাছ সাধারণত বর্ষাকালে অগভীর জলাশয়ে প্রজননে অংশগ্রহণ করে থাকে।
ইয়াহিয়া আরও জানান, শিগগিরই আরও দুটি দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্যের খবর আসছে। গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিএফআরআইয়ের ময়মনসিংহে অবস্থিত স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
দেশীয় মাছ সংরক্ষণ এবং পোনা উৎপাদনে গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে ‘একুশে পদক’ পায়।