‘বাবা মায়ের ভুলে ঝরে পরা শিশুদের গল্প’
– মোশারফ হোসাইন
প্রত্যেকটা মানুষের জীবন শুরু হয় বিশ্বাস নিয়ে । যার মূল ভিত্তিই বিশ্বাস। শিশু যখন প্রথম জন্মায় হাসপাতালে অনেক শিশুর মধ্যে নার্স যেই শিশুটাকে মায়ের কোলে তুলে দেয়, মা তাকে পরম বিশ্বাসে নিজের বলে মেনে নেয়। মা কখনো ওই নার্সকে জিজ্ঞাসা করেনা এটা আমার সন্তান নয়!। শিশু যখন প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয় । মা কখনো ফেলে দেয়না বরং পরম আপন মনে বোকেই টেনে নেয় । কারণ প্রত্বেক ছেলে বাবা মায়ের কাছে রাজপুত্র আর প্রত্বেক মেয়েই তার বাবা মায়ের কাছে রাজকন্যা ।
‘মা যখন শিশুটি বাবার কোলে তুলে দিয়ে বলে এটা আমাদের সন্তান বাবাও পরম বিশ্বাসের সাথে তাকে আঁকড়ে ধরে। বাড়ীর অন্যরাও তাই। শিশুটির বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন শিখানো হয় এটা গাছ’ এটা পাখি’ এটা মাটি’ এটা পানি’ এটা নাক মূখ চোখ ইত্যাদি। শিশুটাও সরল মনে বিশ্বাসে সাথে তাই শিখে। সে কখনো জিজ্ঞাসা করেনা, কেন এটা গাছ কেন? ‘এটা পাখি’ । এটা পানি কেন এটা মাটি বা অন্য কিছু । কিন্ত কিছু সময়ের পরিক্রমায় বাবা মায়ের ভুলে শিশুর এই সরল বিশ্বাসও শিশুর মনে ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস ধারণ করে বসে। আর ঝরে পরে শিশুর উজ্জল ভবিষৎও ।
ঘটনা-(১) : সাকিব বয়স ৮ বছর । তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে । কিন্তু তার আর পড়াশোনা করা হবেনা । কারণ সেও একজন শ্রমিক হতে চাই । ঢাকায় গিয়ে কাজ করতে চায়- ইউনিয়ন পরিষদের এসেছে জন্ম নিবন্ধন নিতে । সে ঢাকায় যাবে । এখন থেকে নিজের পথ নিজে খুজে নিবে । জন্ম নিবন্ধনে বাবার নামের যায়গায় বাবার নাম দেওয়া হলো। যখন তার মায়ের নাম কি জিজ্ঞাসা করা হলো সাকিব অঝড়ে কাদঁকে থাকলো। আর বলতে লাগলো ‘মা’ বলতে তার কেউ নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো তার ‘মা’ মারা গিয়েছেন সেজন্য কাদঁছে । তারপর সবাই মিলে ছেলেটির প্রতি মায়া দেখিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম ‘মানুষ চিরদিন বাঁচে না’। ছেলেটির কান্না আরও বাড়তে থাকলো। আমরা তাকে সান্ত¡না দিয়েও কান্না থামাতে পারছিনা । ছেলেটিও কোন ভাবে তার মায়ের নামও বলতে রাজি না, জন্ম নিবন্ধনে তার মায়ের নাম দিবেনা বললো । ছেলেটির অদ্ভুত আচরণ দেখে আমরা অনেকটাই বিরক্ত কিন্তু কাহিনী কি আগে তা জানতে হবে। জানতে পারলাম তার খালু পাশের বাজারে মোদি দোকানদার । তাকে ডেকে আনতে লোক পাঠালাম, তিনি আসলেন, তার কাছ থেকে জানতে পারলাম এক বছর আগে ৭ বছরের সাকিব আর ৮ বছরের সংসার ফেলে পাড়ার একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেয়েছে তার ‘মা’। তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে ৬মাস হয়েছে । ছেলেটিকে দেখাশোনা করার কেউ নেই । অথচ সুন্দর একটা জীবন ছিল তার। একদম গোছালো জীবন ছিল । একসময় তার পৃথীবিতে সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ ছিল ‘মা’ এখন সবচেয়ে ঘৃন্নিত ব্যক্তি তার ‘মা’ ।
ঘটনা-(২) : পথশিশু সুজন বয়স মাত্র ১০ বছর । তার বাবা ‘মা’ কে! জানে না সে। তার স্মৃতিশক্তি বলে সে রেললাইনের ধারেই বড় হচ্ছে তার বাবা-মা ভাইবোন খেলার সাথী বলতে আশেপাশের তার মতো বন্ধুরা। তাদের গল্পও এমনি । সুজন ধারনা করতে পারে বলে তার বাবা মা হয়তো তাকে রাস্তারধারে ফেলে যেতে পারেন । কারণ তার দেখা এমন অনেকে আছে যাদের রাস্তারধারে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সুজন একটা গল্প বলে । একদিন খুব ভোরে কুকুরের ঘেউঘেউ ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুমের ধান্দায় লক্ষ্য করলাম একদম ছোট একটা শিশুকে (নবজাত) ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যাচ্ছে । আমার দেখে খুব কষ্ট লাগলো। মনে হলো হয়তো আমার বাবা মাও আমাকে এভাবেই রাস্তায় ফেলে গেছে। কিন্তু ফেলার যাওয়ার কারণটা কী! কারো কাছে তার জানা হয়নি ।
ঘটনা-(৩) : বাবা প্রতিদিন ঝগড়া করে। প্রায় প্রতি রাতে তাদের ঝড়গার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায় । আমি ছোট মানুষ বাবা মাকে কিছু বলতেও পারিনা। আমি তাদের ঝগড়া শুনছিনা ঘুমাচ্ছি সে অভিনয় করে থাকি । সত্যি বলতে সেসময়টা খুব কষ্টকর একটা সময়। যখন পড়তে বসি বাবা মা’ কারণ অকারণে ঝগড়া করে। পড়তে বসলে পড়ার মধ্য আর মন থাকেনা। আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তাদের ঝগড়ার জেড়ে একসময় তাদেও বিচ্ছেদ হয়। বিপদে পড়ে যায় আমি । আমি এখন কার কাছে থাকবো? । বাবার কাছে? না মায়ের কাছে? তাদের মধ্যে এই নিয়ে বেশ র্তক বির্তক চলে। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম । রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরি। না এখন বাবার কাছে থাকি । না মায়ের কাছে । আমি এখন পথে ঘাটেই থাকি । আমি এখন আমার মতো পথেঘাটে থাকা ১২ জনের লিডার । শাহীন লিডার ।
(মোশারফ হোসাইন , শিশু সাহিত্যিক ও শিশু সাংবাদিক)
(শেরপুর টাইমস ডট কমের “সাহিত্য পাতা” সকলের জন্য উন্মুক্ত। আপনার স্বরচিত ছড়া- কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ইমেল করুন sherpurtimesdesk@gmail.com এই ঠিকানায়।)