“নারী মানেই ঘরকুনো, নারী মানেই নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যেই থাকতে হবে” সমাজে এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে খুলনার মেয়ে কাজী আসমা আজমেরী বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন পৃথিবীর ১১৫ টি দেশ।
কাজী আসমা আজমেরী। জন্ম খুলনায়। কাজী গোলাম কিবরিয়া ও কাজী সাহিদা আহমেদের দুই সন্তানের মধ্যে আজমেরী বড়। পড়াশোনা করেন বড় ইকবালনগর গার্লস হাইস্কুলে। সেখান থেকে এসএসসি পাসের পর খুলনা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ কমপ্লিট করেন।
কাজী আসমার ভ্রমণ জীবনের শুরু ২০০৮ সালে। পুরোদস্তুর পর্যটকজীবনের শুরু ২০০৯ সালে। সে বছর দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল, ভুটানসহ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় পা রাখেন। ২০১০ সালে ঘোরেন মিসর, মরক্কো, তুরস্ক, চীন, ফ্রান্স, ব্রুনেই, বেলজিয়ামসহ ১১টি দেশ। এভাবেই শুরু। এরপর গিয়েছেন কিউবায়।
এই পরিব্রাজক ২০১৬ সালে ঘুরে বেড়িয়েছেন আরব ও ইউরোপের ১৯টি দেশ।
এরপর পর্যায়ক্রমে ফিলিপাইন থেকে মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কানাডা, বেলারুশ, জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান হয়ে তুর্কমেনিস্তান পৌঁছে শত দেশ ভ্রমণের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন আসমা। দেশ ভ্রমণের তৃষ্ণা তাঁর মেটেনি, আরো ঘুরতে চান। নিজ দৃষ্টিতে দেখতে চান সারা বিশ্বের রূপবৈচিত্র্য।
তবে ভ্রমণে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও কম হয়নি, বাঁধা-বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে তাকে বহুবার। তবুও হাল ছেড়ে পিছু চলে আসেনি। নারীরও রয়েছে যে তীব্র জেদ আর স্বপ্ন জয়ের কঠিন মনোভাব, তা দেখিয়ে দিয়েছেন কাজী আসমা। আসমা বলেন, আমার কাজিন, পাড়াপ্রতিবেশী বা বন্ধুরাও এটা সহজ ভাবে নিতো না। তারা বলতো, কেন তুমি এভাবে নিজের টাকা খরচ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেন ইউরোপে একা একা ঘুরে বেড়াবে? এরকম অনেক সমস্যা হয়েছে।” তাছাড়া বাংলাদেশের একজন নারী হিসেবে বা মুসলিম কালচারের দিক থেকে এটা ডিফিকাল্ট। তবে মানুষের সাথে কিভাবে মিশতে হবে, কিভাবে তাদের ফেস করতে হবে এই ব্যপার গুলো নিয়েও ভাবতে হয়েছে, নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে হয়েছে।
ভোগান্তির ব্যপারে এই পরিব্রাজক বলেন, একজন নারী হিসেবে, পর্যটক হিসেবে আমাকে সব সময়ই স্ট্রাগল করতে হয়েছে। ভিসা নিয়ে, অন্য নানা কিছু নিয়ে। যেহেতু বাংলাদেশি পাসপোর্ট আমার তাই ইচ্ছে করলেই যে কোন দেশে যেতে পারি না। আমাকে ভিসা পাবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
বিশেষ করে ভিয়েতনাম যাওয়ার পর বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে প্রায় ২৬ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ। সেদিনের ভোগান্তির পর আসমা সিদ্ধান্ত নেন নারী হলেও সারা বিশ্ব একাই ঘুরবেন, আর এ ভ্রমণ হবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই। এভাবেই তিনি দেশ ভ্রমণে সেঞ্চুরি করেন।
কাজী আসমার পাসপোর্ট, টাকা পয়সাও চুরি হয়ে গিয়েছিল, চুরি হয়েছিল প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও।
আর ভ্রমনের খরচের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে হয় তাকে। তিনি ২০১২ সালে নিউজিল্যান্ডে ছিলেন, তখন সেখানেও চাকরি করে ভ্রমণের টাকা জমিয়েছেন।
২২ মাইল পথ পায়ে হাঁটতেও হয়েছে আসমাকে। আসমা বলেন, বলিভিয়ায় চে গুয়েভারাকে যে জায়গাটায় হত্যা করা হয়েছিল, ২২ মাইল পায়ে হেঁটে সেই জায়গাটায় গিয়েছি। আর এটা কেবল দৃঢ় মনোবলের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
ভ্রমণকন্যা আজমেরী বলেন, বাংলাদেশ আমার দেশ, আমি চাই এ দেশকে মানুষ চিনুক। আমরা বাংলাদেশীরা কোনো কোনো দেশে হয়তো যাই শ্রমিক হয়ে, কিন্তু আমরা ভ্রমণপিপাসু এবং পর্যটক হিসেবেও যে কোথাও যেতে পারি সেটা আমি দেখাতে চাই।
তিনি জানান, এমন অনেক দেশে গিয়েছেন যেখানে বাংলাদেশকে লোকে চেনে না, ‘ইন্ডিয়া’ মনে করে। তখন আজমেরিকে বুঝিয়ে বলতে হয় যে বাংলাদেশ কোথায়।
কাজী আসমা দেশে ফিরেই ব্যক্তি উদ্যোগে একটি গ্রন্থাগারসহ তৈরী করেছেন বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন।
কাজী আসমা বলেন, স্বপ্ন জয়ের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মানসিক শক্তি, ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস। কারণ অর্থের চেয়ে বেশি কাজে দেয় আত্মবিশ্বাস। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। আমি দেখেছি যে দেশে মেয়েরা কোনো কাজ করে না, সেই দেশ দরিদ্র। আর যেখানে মেয়েরা কাজ করছে তারা উন্নত এবং উন্নতির পথে রয়েছে। বাংলাদেশে এখন মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে আছে বলেই দ্রুত গতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।