শেরপুরে যৌতুক ও নির্যাতনের মামলায় হাজত খাটার পর এবার উল্টো সেই প্রতারক প্রেমিক স্বামী ইব্রাহিম খলিলের (২৮) দায়ের করা মামলায় হুইল চেয়ারে বসেই কারাগারে যেতে হয়েছে প্রতিবন্ধী সুমাইয়া আক্তারকে (২৬)।
সোমবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে ইব্রাহিমের দায়ের করা ‘জাল-জালিয়াতি’র মামলায় প্রতিবন্ধী সুমাইয়া আক্তারসহ ৫ জন শেরপুরের আমলী আদালতে স্বেচ্ছায় হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানালে উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানী শেষে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারিন ফারজানা আবেদন নাকচ করে তাদের সকলকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
অন্য ৪ জন হচ্ছেন- সুমাইয়ার বড়ভাই আব্দুস সাত্তার (৩৫), চাচা মফিজুল হক (৫২), ভাতিজা আসাদুজ্জামান লিটন (৩৮) ও আত্মীয় শামসুল হক (৪৫)। আদালতের ওই আদেশের পর হুইল চেয়ারে বসিয়েই প্রতিবন্ধী সুমাইয়াকে প্রথমে কোর্ট হাজতে ও পরে গাড়িতে কারাগারে নেওয়া হয়। এসময় আদালত অঙ্গনে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিবন্ধী সুমাইয়ার আইনজীবী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম ভাসানী বলেন, প্রেমিক খলিল প্রতিবন্ধী সুমাইয়ার সরলতার সুযোগ নিয়ে তার জীবনের সাথেই প্রতারণা করেছে। তার তথাকথিত জালিয়াতির মামলাটি আশা করছি উচ্চ আদালতে টিকবে না এবং সুমাইয়া ন্যায়বিচার পাবে। অন্যদিকে খলিলের জাল-জালিয়াতির মামলাটিই সঠিক দাবি করে তার আইনজীবী এ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম মমিন বলেন, কেবল প্রতিবন্ধীর কথা বলে আইনে আবেগের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। সুমাইয়ার ২ মামলার হাজত খাটার পর এবার খলিলের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, শেরপুর সদর উপজেলার কুমড়ি কাটাজান গ্রামের কৃষক মৃত ইকাতুল্লাহর কনিষ্ঠ মেয়ে সুমাইয়া আক্তারের ৩ বছর বয়সেই টাইফয়েড জ্বরে দু’পা অচল ও ক্ষীণকায় হয়ে পড়ায় সে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। এরপর থেকে সে হাতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও পিছিয়ে থাকেনি পড়াশোনা থেকে। কুমড়ি তেঘরিয়া ফাজিল মাদরাসায় পড়া অবস্থায় ২০১২ সালে শহরের একটি কোচিং সেন্টারে কোচিং করতে গিয়ে পরিচয় হয় সদর উপজেলার দীঘলদি গ্রামের শামছুল হকের ছেলে ইব্রাহিম খলিলের সঙ্গে। সেই পরিচয়ের পর সম্পর্ক এবং সম্পর্কের সূত্রে একপর্যায়ে ২০১২ সালের ১০ আগস্ট তারা বিয়ে করে। কিন্তু তাদের বিয়ের বিষয়টি জানার পর খলিলের অভিভাবকরা তা মেনে না নেয়ায় খলিল সুমাইয়াদের সংসারে গিয়েই দাম্পত্য জীবন শুরু করে। এক পর্যায়ে খলিল গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকে। সুমাইয়ার পরিবারের অভিযোগ, চাকরিতে ঢুকার পর থেকেই সুমাইয়ার প্রতি চরম উদাসীন হয়ে পড়ে খলিল। তার খোঁজ-খবর রাখা তো দূরে থাক, বেড়ে যায় যৌতুকের দাবিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে খলিল জামালপুরের মিশু নামে এক মেয়েকে বিয়ে করে।
এদিকে, সুমাইয়া বাধ্য হয়ে স্বামী ইব্রাহিম খলিলের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট শেরপুরের সি,আর আমলী আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে এবং পারিবারিক আদালতে মোহরানা ও খোরপোষ আদায়ের দাবিতে দু’টি পৃথক মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে সমন পেয়ে যৌতুক নির্যাতন মামলায় হাজির হয়ে হাজতে গেলেও এক সপ্তাহ পর জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায় খলিল। এরপর শুরু হয় খলিলের প্রতারণার ক‚টকৌশল। আর সেই ক‚টকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ইব্রাহিম খলিল ৫ নভেম্বর প্রতিবন্ধী সুমাইয়া আক্তারের সঙ্গে দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক অস্বীকার এবং তাদের মধ্যকার বিগত ১০/০৮/১২ তারিখে সংঘটিত কাবিননামাটি জাল-জালিয়াতি বলে দাবি করে সুমাইয়া আক্তার ও তার যৌতুক নিরোধ আইনের মামলার ৪ সাক্ষীসহ মোট ৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি পাল্টা মামলা করে। সুমাইয়ার পরিবারের অভিযোগ, তাদের বিবাহ রেজিস্ট্রির বিষয়টি ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের মূল কাজী সৈয়দ আহম্মেদ অস্বীকার করলেও সম্পাদনকারী সহকারী কাজী আবদুল বাসেত সাক্ষ্যপ্রদানকালে তা স্বীকার করেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। সেই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা নেই মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। এরপর বাদীপক্ষ আদালতে নারাজী দাখিল করলে চলতি বছরের ৩ মার্চ আমলী আদালত নারাজীর আবেদন মঞ্জুর করে সরাসরি সুমাইয়াসহ ৭ আসামির বিরুদ্ধেই অভিযোগ আমলে গ্রহণ করে তাদের প্রতি আদালতে হাজির হওয়ার সমন ইস্যু করেন।