নবী করিম (সা.) নারীদের অধিকার সম্পর্কে আমলি নমুনা পেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতেন। জাহেলি যুগে নারীদের ওপর সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন করা হতো। কন্যাসন্তান জন্ম নেয়াকে দোষ ও কলঙ্কের কারণ মনে করা হতো। যার ঘরে কন্যাসন্তান জন্ম হতো, সমাজে তার মুখ দেখানোর কোনো জায়গা ছিলো না। এ কারণে কন্যাসন্তান হলেই জীবন্ত সমাধিস্থ করা হতো।
নবী করিম (সা.) আগমন করে এ সকল সামাজিক প্রথার বিলুপ্তি ঘটান। মনুষ্যত্বহীন জাহিলিয়াতের বর্বরতাকে দূর করে নারীকে দান করেন সর্বোচ্চ সম্মান। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদেরকে দিয়েছেন পরিপূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার। নিজ পরিবারের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে আমলি নমুনার মাধ্যমে নবী করিম (সা.) উম্মতকে শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে নারীদের হক আদায় করতে হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে এর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপও করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। আর আমি তোমাদের মধ্যে আপন স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম আচরণকারী’।
উত্তম ও মুত্তাকি হওয়ার সনদ প্রদান করবে নিজ স্ত্রী:
ডাক্তার আব্দুল হাই (রহ.) হজরত আশরাফ আলি থানভি (রহ.) এর বিশিষ্ট খলিফাদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন মাওলানা তকি উসমানি দা.বা. এর শায়খ। তিনি সবসময় বলতেন, ‘মাওলানা হওয়ার সনদ দেয় মাদরাসার পরিচালকগণ, ডাক্তার হওয়ার সনদ দেয় মেডিকেল কলেজের পরিচালকগণ, কিন্তু নেক ও মুত্তাকি হওয়ার সনদ প্রদান করবে নিজের স্ত্রী। আমি সকল পুরুষকে বলবো, আপনারা পুনরায় আইয়ামে জাহিলিয়াতের দিকে ফিরে যাচ্ছেন। নারীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন আমাদের দেশে আগের চাইতে অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এ দেশে বসবাস করি। এখানের মানুষ সমাজের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। আমরা ধর্মকেও সামাজিক রেওয়াজের অনুকরণে মান্য করি। তো আমাদের সমাজের অবস্থা এমন যে, এখানে নারীদের পায়ের জুতোর মতো নিকৃষ্ট মনে করা হয়। কেবল এই সময়ের সাধারণ জনগণ নয়; বরং আমাদের পূর্বপুরুষরাও দ্বীনের সেইসব রেওয়ায়ত ও নকশা আমাদের সামনে নিয়ে আসতেন, যার মধ্যে নারীদের ওপর বর্তমান সময়ে চলমান বর্বর আচরণের কথা উল্লেখ আছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। আমি তোমাদের মধ্যে স্ত্রীগণের সঙ্গে উত্তম আচরণকারী’।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ঘরোয়া পরিস্থিতি:
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ঘরোয়া অবস্থা সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আচরণ ও চরিত্রের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ঘরে আগমন করতেন, তখন আমাদের সকল কাজে তিনিও সমানভাবে শরিক হতেন’। সামাজিক রীতি-নীতির কারণে আমাদের মনে এ কথা বসে গেছে যে, পুরুষ বাহিরে কাজ করবে আর নারী ঘরে বসে খানা তৈরি করবে। আসলে এমন কিছুই না। বরং স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাজে সাহায্য করবে। ওপরের হাদিস থেকেও জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও বাহির থেকে এসে স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করতেন। যখন তিনি বাহিরে থাকতেন, তখন হজরত আয়েশা (রা.) ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কোনো কাজে মশগুল থাকতেন৷ এতে তাঁর কাজটা সহজ হয়ে যেতো।
কেনো ভাই, সে একা কেন ঘরে কাজ করবে? তাদের শরীরও তুলনামূলক দুর্বল। তার পরিশ্রম আরো কম হওয়া উচিৎ। হজরত আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘরে ধোয়া-মোছার কাজ করতেন। এছাড়াও নিজের কাপড় ধোয়া, জুতা সেলাই করা, গৃহপালিত পশুকে খাদ্য দেয়া, হজরত আবু বকর (রা.) এর বকরির দুধ দোহন করা, গাছ থেকে ফসল কাটা, আটা পিষা ইত্যাদি তাঁর নিত্যদিনের কাজ ছিল’। এসকল ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুকরণকারী অন্তত একজন ব্যক্তিরও দেখা মেলে না। কেউ কি বলতে পারবেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবেসে তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করে সুস্থ স্ত্রী থাকা সত্তেও আটা পিষেছি? আটা পিষা তো দূরের কথা, যদি আটা পিষার নামও কেউ শোনে, তাহলে লোকেরা বলবে, দেখো হাজি সাহেব বা মাওলানা সাহেব একী করছেন! রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কি কেউ হতে পারে? অথচ তিনি নিজ স্ত্রীকে ঘরোয়া কজে সাহায্য করে উম্মতের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন।
স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার:
নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার কী কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাকে উত্তম খাবার খাওয়াবে ও উত্তম পোশাক পরিধান করাবে’। ফোকাহায়ে কেরামের মতে ভালো খাবার ও ভালো পোশাক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রস্তুতকৃত খাবার ও সেলানো কাপড় স্ত্রীকে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। এখন যদি স্বামী খানা রান্না করে স্ত্রীকে খাওয়ায়, তাহলে এটা তার স্ত্রীর ওপর দয়া করছে না; বরং সে তার দায়িত্ব আদায় করছে। আর যদি স্ত্রী নিজের খাবার নিজে রান্না করে খায় এবং স্বামীর জন্য রান্না না করে, তবুও সে স্বামীর ওপর দয়া করলো। যদি স্বামীর জন্যও রান্না করে, তাহলে দ্বিগুণ দয়া করলো। আর যদি স্বামীর সন্তানের খানাও রান্না করে দেয়, তাহলে সে স্বামীর ওপর দশ এহসান করলো। যদি স্বমীর মা-বাবা, ভাই-বোনের খানাও রান্না করে দেয়, তাহলে স্বামীর ওপর সে একশ এহসান করলো। সে এটা করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তারা তোমাদের পরিধেয় পোশাকের মতোন আর তোমরা তাদের পরিধেয় পোশাকের মতোন’।
স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং একজনের দুঃখ-কষ্টে অন্যজন শরিক থাকার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলাম এ বিষয়ের প্রতি অনেক গুরুত্বারোপ করেছে। এসকল কাজ করা স্ত্রীর দায়িত্ব না। খানা রান্না করতে দেরি হলে বা লবণ বেশি হলে স্ত্রীকে বকাঝকা করা, গালমন্দ করা, তালাক পর্যন্ত চলে যাওয়া-এটা কেমন কথা? এর চাইতে গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ আর নেই। মনে রাখবেন, আল্লাহর দরবারে আপনার রীতি-রেওয়াজ মতো বিচার হবে না, বরং ইসলামি আইন অনুযায়ী বিচার হবে। সুতরাং সতর্ক হয়ে যান এবং স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করার অভ্যাস করুন।
ভালোবাসাময় মুহুর্ত:
নবী করিম (সা.) নিজ স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো অনুরাগী ও ভালোবাসাময় করে তুলতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমার ঘুম খুব পাতলা। আমার মা-বাবা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওপর কোরবান হোক, তিনি যখন তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন, তখন আমার ঘুমের যেনো কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, এজন্য খালি পায়ে খুব আস্তে আস্তে ওজু করে আসতেন। ব্যবসা বা দাওয়াতি কাজের কোনো সফর থেকে ফিরতে যদি রাত হয়ে যেতো, তাহলে ঘরে না এসে রাতটা মসজিদে কাটিয়ে দিতেন। ঘুমের ব্যাঘাত হবে বলে এত রাতে ঘরের দরোজায় করাঘাত করতেন না’।
অথচ আমরা রাত একটা-দুইটা বাজে চাকরি-বাকরি, চায়ের আড্ডা, বিভিন্ন আমোদপ্রমোদ থেকে এসে দরজায় জোরে করাঘাত করতে থাকি। স্ত্রী কাঁচা ঘুম আর সারাদিনের ক্লান্তির করণে যদি দরোজা খুলতে সামান্য দেরি হয়, তাহলে তালাক পর্যন্ত দিয়ে বসি! এসবের পরেও বলি, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসি। রাসূলুল্লাহ (সা.) ৫৩ বছর বয়সে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। এক বছর পর হজরত আয়েশা (রা.) এর রোখসত হয়। অন্য রেওয়ায়েত অনুযায়ী দুই বা তিন বৎসর পর রোখসত হয়েছিল। এ হিসেবে ৫৫ বছর বয়সের পর হজরত আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দৌড় প্রতিযোগিতার প্রমাণ আছে। একটি মাঠে সেই প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আমরা মদিনায় অবস্থানকালে একবার সেখানের এক বুজুর্গ আমাদেরকে মদিনা ঘুরিয়ে দেখানোর সময় সে জায়গাটি দেখিয়ে বললেন, এখানে আমাদের নবী (সা.) হজরত আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়েছিলেন। দু’বার দৌড়ের মধ্যে প্রথমবার হজরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সামান্য আগে চলে যান, দ্বিতীয়বার রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে এগিয়ে যান। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে আয়েশা, সমান সমান হলো এবার’! স্ত্রীর সঙ্গে এমন ভালোবাসাময় আচরণ করে আমাদেরকে তিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
ভারতীয় দাঈ মাওলানা কালিম সিদ্দিকির কলাম থেকে অনূদিত