বিচিত্র পেশা রয়েছে এই দুনিয়ায়। তেমনই এক পেশা হলো পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ। মাছ শিকারিদের জন্য পিঁপড়ার ডিম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। পিঁপড়ার ডিম বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই ডিম মাছের লোভনীয় খাবার। তাই মাছ শিকারিদের কাছে পিঁপড়ার ডিমের অনেক চাহিদা। শেরপুরের সীমান্তবর্তী তিন উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও মুসলিম পরিবার পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহের পর তা বিক্রি করে সংসার চালান।
জানা গেছে, শেরপুর সীমান্তজুড়ে গারো পাহাড়। এই পাহাড়ে প্রচুর গাছ থাকায় পিঁপড়ার বাসা খুব সহজে হয়। বিশেষ করে ঝিনাইগাতী, নালিতবাড়ী ও শ্রীবরর্দী উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর প্রায় দুই শতাধিক মানুষ উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন পিঁপড়ার ডিম খোঁজাকে। বিভিন্ন দেশীয় গাছ থেকে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করা হয়। এই ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটি খুব সতর্কের সঙ্গে করতে হয়। ডিমগুলো মাছের খাবার হিসেবে বিক্রি হয়। ডিম আস্ত না রাখলে মাছ খায় না। গরমে পিঁপড়ার ডিম নষ্ট হয়ে যায়। ডিম ছায়াযুক্ত স্থানে বাঁশের খাঁচায় টানিয়ে রাখতে হয়।
ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, তারা প্রতিদিন সকালে ৩-৪ জন করে একটি দল পাহাড় ও জঙ্গলে পিঁপড়ার বাসা এবং ডিম খোঁজার কাজে বেরিয়ে পড়েন। যা চলে বিকেল পর্যন্ত। ডিম সংগ্রহ শেষে সন্ধ্যায় তা বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়ে চলছে তাদের সংসার। তারা আরো জানান, সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর ১-২ কেজি ডিম সংগ্রহ করা যায়। ভাগ্য ভালো ও আবহাওয়া অনুকূল থাকলে ২-৪ কেজি পর্যন্ত পিঁপড়ার ডিম পাওয়া যায়। সিজন অনুযায়ী সেই ডিম প্রতি কেজি ৬শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকায় বিক্রি করেন তারা।
ঝিনাইগাতীর বাকাকুড়া গ্রামের ডিম সংগ্রহকারী নিরঞ্জন বলেন, পাহাড়ে সাধারণত মেহগনি, আম, লিচুসহ দেশীয় গাছগুলোতে ডোল পিঁপড়ার বাসা পাওয়া যায়। লালা ব্যবহার করে গাছের ডালের আগার দিকের চার-পাঁচটা পাতা জোড়া দিয়ে শক্ত বাসা তৈরি করে পিঁপড়ার দল। পরে সেখানে তারা ডিম দেয়। বড় বাসায় একশ থেকে দেড়শ গ্রাম ডিম পাওয়া যায়। আশ্বিন-কার্তিক মাসের দিকে এই ডিমের চাহিদা থাকে বেশি। তবে সব থেকে বেশি ডিম পাওয়া যায় শীতের শেষের দিকে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে। কিন্তু সেই সময় ডিমের চাহিদা তেমন একটা থাকে না। প্রতিদিন সকালে বের হয়ে একটানা বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। এ সময়ে কোনোদিন এক কেজি, কোনোদিন দুই কেজি আবার এমন সময় আছে আধা কেজিরও কম পিঁপড়ার ডিম পাই । এসব ডিম বিক্রি করে যে টাকা পাই তা দিয়েই সংসারটা চলছে। আমার আয়ের আর কোনো রাস্তা নেই। তাই এটাই করি। আগে মানুষ কম ছিল, তবে এখন ডিম সংগ্রহেও মানুষ বাড়ছে অনেক। নকশি গ্রামের ডিম সংগ্রহকারী রঞ্জন সাংমা বলেন, বর্তমানে আমার কোনো কাজ নেই। আগে একটা দোকানে ছিলাম, সেখান থেকে যে টাকা পেতাম তা গাড়ি ভাড়া দিতে দিতেই শেষ হয়ে যেত। তারপরও কষ্ট করে ছিলাম। কিন্তু মালিক আমাকে কাজ থেকে বাদ দিলে আমি বেকার হয়ে পড়ি। তাই বাধ্য হয়েই পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহের কাজ করছি, আর তা বিক্রি করেই চলছে আমার সংসার। রিংকি কোচ নামে রাংটিয়া গ্রামের আরেক ডিম সংগ্রহকারী বলেন, সব পিঁপড়ার বাসায় ডিম পাওয়া যায় না। ডিম সংগ্রহ করি ঠিক আছে, তবে বেচার সময় দাম কম দেয়। যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চলানো কষ্ট হয়।
বাকাকুড়া এলাকার পিঁপড়ার ডিম ব্যবসায়ী আবু সিদ্দিক বলেন, আমি বাকাকুড়া, রাংটিয়া, গজনী, নকশির কয়েকজনের কাছে পিঁপড়ার ডিম কিনে রাখি। পরে মাছ শিকারি ও শেরপুরের বিভিন্ন দোকানে পাইকারি বিক্রি করি। অন্য ব্যবসার পাশাপাশি এ ব্যবসা থেকেও আয় হয়। আমি প্রতিদিন প্রায় ৫-১০ কেজি ডিম বিক্রি করি।
পিঁপড়ার ডিমের পাইকাররা জানান, সংগ্রহ করা ডিম কিনে তারা শেরপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন। ডিমের পাইকার অনয় কোচ বলেন, সংগ্রহকারীরা সারাদিন ডিম সংগ্রহ শেষে আমার কাছে বিক্রি করতে আনে, আমি সেই ডিম কেজি প্রতি ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা দরে কিনে নেই। আবার সেই ডিম আমি বিভিন্ন দোকানে ৮শ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি করি।